প্লাস্টিকের বোতলের তৈরি বাড়ি মুশকিল আসান হয়ে উঠছে
২৬ আগস্ট ২০১১পরিবেশ বনাম প্লাস্টিক
আধুনিক এই যুগে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের মোড়ক, প্লাস্টিকের বোতল, প্লাস্টিকের রকমারি জিনিসপত্র৷ পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক কতটা ক্ষতিকর, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না৷ কারণ বর্জ্য হিসেবে প্লাস্টিকের বিনাশ প্রায় অসম্ভব বলা চলে৷ কিন্তু আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় প্লাস্টিকের বোতলের অভিনব ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে৷ বোতল দিয়ে আস্ত বাড়ি তৈরির উদ্যোগ চলছে সেখানে, যার পেছনে রয়েছেন জার্মানির ছুতোর মিস্ত্রি আন্দ্রেয়াস ফ্র্যোজে৷
বোতল-বাড়ির রহস্য
আন্দ্রেয়াস গোটা বিষয়টি বেশ সহজভাবে ভেবে রেখেছেন৷ প্রথমে প্লাস্টিকের খালি বোতলে বালি ও আবর্জনা ভরে ফেলতে হয়৷ সেগুলি দিয়ে দেওয়াল তৈরি করা হয়৷ বোতলগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়তে অবশ্যই মাটি বা সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়৷ গোটা কাঠামো স্থিতিশীল রাখতে নায়লনের দড়ি ব্যবহার করা হয়৷
সহজ এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন আন্দ্রেয়াস৷ একদিকে পরিবেশ দূষণ কমাতে চান তিনি, অন্যদিকে গরিব মানুষের জন্য জীবিকা অর্জনের নতুন এক পথও খুলে দিতে চান৷ বছর দশকের আগে এই উদ্দেশ্যে তিনি দক্ষিণ অ্যামেরিকার দেশ হন্ডুরাসে একটি কোম্পানি শুরু করেছিলেন, যার নাম ইকো-টেক৷ এর মধ্যে গোটা বিশ্বে ৫০টি বাড়ি তৈরি করেছে এই সংস্থা৷ প্লাস্টিকের বোতলের তৈরি হলেও বেশ মজবুত ও নিরাপদ সেই সব বাড়ি৷ এমনকি রিশটার স্কেলে ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে এই বাড়ি৷
কিন্তু আন্দ্রেয়াস যখন কাউকে প্রথম বারের মতো এই প্রকল্পের কথা বলেন, তখন খুব একটা উৎসাহ দেখতে পান না৷ নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘প্রথমদিকে উৎসাহের বদলে সংশয়ই বেশি দেখা যায়৷ কিন্তু যেহেতু এমন বাড়ির ধারণা গতানুগতিক নয়, সেকারণেই বিষয়টি আকর্ষণীয়৷ কৌতূহল মেটাতে অনেক মানুষ নির্মাণ কাজ দেখতে আসেন৷ তখন আমরা তাদের দেখাতে পারি, কীভাবে আমরা কাজ করছি৷ তারা আরও বুঝতে পারেন, যে সাধারণ ইটের চেয়ে প্লাস্টিকের বোতল অনেক বেশি টেকসই৷ উপাদান হিসেবে বোতল আরও শক্ত এবং আরও বেশি ধাক্কা সামলাতে পারে৷''
দক্ষিণ অ্যামেরিকা থেকে আফ্রিকা
বছরখানেক আগে আন্দ্রেয়াস আফ্রিকায় এই প্রকল্প শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন৷ তিনি প্রথমে উগান্ডায় জলের এক ট্যাঙ্ক তৈরি করেন৷ এখন তিনি নাইজেরিয়ায় ‘ডেয়ার' নামের সংগঠনের সঙ্গে মিলে একটি প্রকল্প শুরু করেছেন৷ কাদুনা'য় আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম প্লাস্টিকের বোতলের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে৷ হোটেল, রোস্তোরাঁ, দূতাবাস ও সাধারণ বাড়িঘর থেকে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল সংগ্রহ করা হচ্ছে৷
প্লাস্টিকের বোতলের তৈরি এই বাড়ি যতটা সম্ভব পরিবেশ বান্ধব করে গড়ে তুলছেন আন্দ্রেয়াস৷ এই বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বাড়ির নিজস্ব পয়ঃপ্রণালী থাকবে এবং পানীয় জল শোধনেরও আলাদা ব্যবস্থা থাকবে৷ নির্মাণের কাজে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহারের আরও একটি সুবিধা রয়েছে৷ নির্মাণের প্রচলিত উপাদানের তুলনায় প্লাস্টিকের বোতলের দাম অনেক কম৷
বোতল-বাড়ি ও কর্মসংস্থান
এই প্রকল্পের আওতায় তরুণ প্রজন্মের প্রশিক্ষণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে৷ নাইজেরিয়ায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চরম বেকারত্ব বড় এক সমস্যা৷ ‘ডেয়ার' সংগঠনের প্রধান ইয়াহায়া আহমেদ মনে করেন, সমাজের জন্য এই সমস্যা একটা টাইম-বোমার মতো৷ বিস্ফোরণ ঘটলে তার পরিণাম হবে মারাত্মক৷ কারণ তরুণ-তরুণীদের মনে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে৷ তারা মনে করে, সরকার তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ স্কুলের গণ্ডি পেরোলেও চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ এই সংকটের প্রেক্ষাপটে ইকো-টেক ও ডেয়ার হাত মিলিয়েছে৷ এরই মধ্যে কিছু সাফল্যের মুখ দেখছে এই যৌথ প্রকল্প৷
ইয়াহায়া আহমেদ বললেন, ‘‘নির্বাচনের পর যেসব হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তাতে এই সব তরুণরা মোটেই জড়িত ছিল না৷ তার আগে কিন্তু এরাই গুন্ডাগিরি করে বেড়াতো৷ এটা সত্যি ইতিবাচক এক প্রবণতা৷ বোতল দিয়ে এই বাড়ি তৈরি করার সময় আমরা রাস্তা থেকে ১৫ জন তরুণ ভিখিরিকে তুলে এনে তাদের কাজ দিয়েছি৷ তাদের শিখিয়েছি, কীভাবে বোতলে বালি ইত্যাদি ভরতে হয়৷ আচমকা আরও প্রায় ৫০০ জন এসে আমাদের কাছে কাজ করতে চাইলো৷ বলাই বাহুল্য, আমাদের পক্ষে এত লোককে কাজ দেওয়া সম্ভব নয়৷ তবে আমরা যদি আরও বোতলের বাড়ি তৈরি করতে পারি, তখন আমরা রাস্তা থেকে আরও তরুণদের নিয়ে এসে কাজে লাগাতে পারি৷ তখন হিংসার প্রবণতাও কিছুটা কমে যাবে৷''
বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দীর্ঘমেয়াদী এক পরিকল্পনার আওতায় নাইজেরিয়ায় এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হবে, যেখানে প্লাস্টিক বোতলের বাড়ি তৈরির উদ্দেশ্যে এলাকার মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷ এখনো পর্যন্ত এই প্রকল্পের কল্যাণে ৯০ জনের কর্মসংস্থান ঘটেছে৷ এরা জানুয়ারি মাসে একটি স্কুল তৈরির কাজে হাত দেবে এবং স্কুলের ছাত্রদেরও বোতল থেকে ইট তৈরির পদ্ধতি শেখাবে৷ যেসব তরুণ কাজের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, তারা আজ অত্যন্ত সন্তুষ্ট৷
কিন্তু সমস্যা দেখা যাচ্ছে বোতল-বাড়ি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে৷ ইকো-টেক বহুকাল ধরে সাফল্য দেখিয়ে এলেও অর্থ সংগ্রহ করা আজও বেশ কঠিন৷ ছোট সংস্থা বা পৌরসভাই মূলত এই সব প্রকল্পে টাকা ঢালে৷ ইয়াহায়া আহমেদের আশা, উন্নয়ন সাহায্যের হাতিয়ার হিসেবেও এই প্রকল্প একদিন জার্মানির মতো দাতা দেশের স্বীকৃতি পাবে৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক