দেশ-বিদেশের শীতে আমার ভাবনা
২৮ জানুয়ারি ২০২১শীতের ছুটিতে সকালে ঘুম থেকে ওঠে ভাই বোনেরা আব্বার হাত ধরে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে বেড়াতে যেতাম৷ নৌকায় বসে মাঝিরা মাছ নিয়ে আর সবজিওয়ালারা অপেক্ষা করতেন শীতের সবজি নিয়ে৷ বিক্রেতাদের সবার মুখেই থাকত হাসি৷ আব্বার উপস্থিতিতে দামদর করার সাহস আমাদের না থাকলেও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতাম৷ আসলে তখন ভরা ব্রহ্মপুত্রই আমাদের কাছে টানত বেশি৷ নদীর ধারে বেড়ানো শেষে বাড়ি ফিরে খেজুরের গুড় দিয়ে আম্মার তৈরি মজার মজার পিঠার স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে৷
বছর তিনেক আগে আমার প্রিয় ব্রহ্মপুত্রকে আবার দেখতে গিয়েছিলাম৷ প্রায় পানিশূণ্য করুণ নদীটিকে দেখে সেদিন আমার সত্যিই কান্না পেয়েছিল৷ আগে ভরা টলটলে পানি দেখেছি যে নদীতে , এখন তা প্রায় পানি শূণ্য! তবে নদীতীরের পার্কটি আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে , নানারকম বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে৷ নদীতে পানি না থাকলেও তার পাশ দিয়ে তরুণ-তরুণীরা হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, দেখে বেশ লাগল!
শীতকালে বাস ভর্তি বন্ধুদের সাথে মাইকে গান শুনতে শুনতে মধুপুর গড়ে পিকনিক করার আনন্দ ভোলার নয়! মধুপুরে এতবড় পিকনিক স্পটে কিশোরী বেলায় ইচ্ছেমতো হারিয়ে যাবার আনন্দই ছিল আলাদা! সেই বিশাল বনের কি অবস্থা এখন ?
জার্মানিতে বন সুরক্ষায় সরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়, বনের গাছ কাটতে গেলে প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের গাছ কাটা বন্ধ করা হয়৷ কারণ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়, তা বারবারই মনে করিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা৷
বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য মানুষ শীতের মৌসুমকে বেছে নেয় আর জার্মানিতে ঠিক তার উল্টো৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মে মাস বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময়৷ না গরম না ঠান্ডা, মিষ্টি একটা আবহাওয়া থাকে তখন৷ যদিও করোনার কারণে এ বছর অনেক বিয়েই বাতিল হয়ে গেছে৷ তবে বাংলাদেশে বিয়ে হচ্ছে আর অনেকেই সেসব ছবি, ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করছেন৷
বিয়ের অনুষ্ঠানে ভীষণ আনন্দ হয় এমনটাই রয়েছে আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে৷ তাই দেশে গেলেই বিয়ের দাওয়াতের জন্য মনে মনে অপেক্ষা করতাম৷ কিছুদিন আগে ঢাকায় এক বিয়েতে যাওয়ার পর সে আগ্রহে ভাটা পড়েছে৷ ডিজিটাল যুগের বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দের চেয়ে সাজগোজ , ছবি আর ভিডিও যেন বিয়ের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাড়িয়েছে৷ বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে খাওয়া-দাওয়ার কমতি না থাকলেও টান পড়েছে আন্তরিকাতায়৷ তবে ফেসবুক বা স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারছি দেশের শীতের পিঠা পুলির রেসিপিসহ নানা নানা উৎসবের খবরাখবর৷
এদিকে জার্মানি বা ইউরোপের শীতে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যেতে চায় না, অন্তত ঘোরাঘুরি বা মজা করতে তো নয়ই৷ পার্ক বা খোলা জায়গাগুলো থাকে প্রায় ফাঁকা আর গ্রীষ্মে এসব জায়গার চেহারা পুরোই পাল্টে যায়, থাকে লোকে লোকারণ্য৷ মানুষের চেহারা,আচরণ সবই গরমকালে কেমন বদলে যায়, তুলনামূলকভাবে মানুষ থাকে বেশি হাসিখুশি আর আন্তরিক৷ শীতপ্রধান দেশের মানুষের প্রায় সব পরিকল্পনাই থাকে বসন্ত আর গ্রীষ্মকে ঘিরে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবকিছুই কেমন যেন উলট-পালট হয়ে গেছে অনেক দেশের মতো জার্মানিতেও৷ এবার শীতে জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর তুষারপাত হলেও আমাদের এখানে বরফের দেখা নেই বললেই চলে৷ করোনার কারণে প্রায় একবছর ঘরবন্দি, অফিসে যাওয়া নেই, হোম অফিস করছি তাই মনে মনে বরফকে ডাকছিলাম৷ শ্বেতশুভ্র বরফের মধ্যে ভাব নিয়ে একখান ছবি তুলে আমিও যেন ফেসবুকে শেয়ার করতে পারি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! কোলনে দুদিন সামান্য বরফ পড়েছে ঠিকই কিন্তু ছবি তোলার প্রস্তুতি নিতে নিতেই দুষ্টু বৃষ্টি এসে সব বরফ গলিয়ে দিয়েছে! জানুয়ারি প্রায় শেষ আর আবহাওয়া যেন অন্যান্য বছরের নভেম্বর মাসের মতো৷ বৃষ্টি যেন প্রতিদিন আসার প্রতিজ্ঞা করেই বসে আছে৷
অথচ কয়েক বছর আগেও অনেক বেশি তুষার পাত হতো জার্মানির নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের আমাদের কোলন বন এলাকায়ও৷ আমাদের অফিস বনে, প্রতিদিন যাতায়াতের জন্য আমি গাড়িটা পার্ক অ্যান্ড রাইড-এ রেখে বাকি পথ ট্রামে যাই৷এই পার্কিং প্লেসটি ফ্রি, যারা পরিবেশ সুরক্ষায় নিজের গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে পাবিলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন সেসব চাকরীজীবির জন্য৷ প্রায় চার বছর আগের কথা, প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছিল আর সে সুন্দর দৃশ্য অফিসের জানালা থেকে দেখেছি৷ ফেরার পথেও ট্রামের জানালা দিয়ে বাচ্চাদের স্নোম্যান তৈরি, স্নো-বল ছুড়োছুড়ি উপভোগ করতে কখন যে আমার স্টপেজে চলে এসেছি টেরই পাইনি৷
গাড়ির পার্কিং প্লেসে এসে তো আমি একেবারে হতভম্ব ! আরে, আমার গাড়ি কোথায়? সবগুলো গাড়ি বরফের চাদরে এমনভাবে ঢাকা যে কোনো গাড়ির সাইজ পর্যন্ত বোঝা যায়না৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল, আশেপাশে কোনো লোকজন নেই, প্রায় শ খানেক বরফ ঢাকা গাড়ির সাথে আমি একা!
এদিকে জলবায়ুর এমন পরিবর্তনে গাছপালারা যেন বুঝতেই পারছে না কখন কোন ঋতু চলছে৷ যে ফুলগাছ এর আগে কখনও ডিসেম্বর জানুয়ারির শীতসহ্য করতে পারেনি সে গাছ কিনা এখনও দিব্যি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে, আমার বাগানে৷ আর মাটির নীচ থেকে এখনই উঁকি দিচ্ছে দু একটা টিউলিপের চারা, স্বাভাবিক অবস্থায় কিন্তু টিউলিপের শীতঘুম মার্চ, এপ্রিলে ভাঙার কথা৷ আর পুদিনা গাছে জানুয়ারি মাসেও সবুজ পাতা, যা কিনা গত বছর পর্যন্তও ভাবা যায়নি৷