দেশপ্রেম কমে গেছে: বুলু
৭ জুলাই ২০১১একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বুলুর সঙ্গে দেখা করতে আসে তাঁর কয়েকজন বন্ধু৷ বুলু তখন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র৷ বিএনসিসি করতেন তিনি৷ তাই একটি এলমজি ছিল তাঁর কাছে৷ বুলুর বন্ধুরাই তাকে জানিয়েছিলেন, ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্তানি বাহিনী৷ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে৷ পরের দিন থেকে বুলুরা শুরু করে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ৷ লক্ষ্য বরিশালকে শত্রুমুক্ত রাখা৷
যুদ্ধ যাত্রা
এভাবেই এলো ১৮ এপ্রিল৷ পাকিস্তানি বাহিনী বরিশালে জোর হামলা শুরু করলো৷ বুলুরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেন৷ কিন্তু সেই প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি৷ বুলু ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান৷ তার পরিবার তাকে প্রথমে যুদ্ধে যেতে দিতে চায়নি৷ কিন্তু মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মাকে বলেছিলাম, প্রতিটি মা যদি সন্তানকে আটকে রাখে তাহলে যুদ্ধ করবে কারা?''
রণক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণ
বুলু ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাননি৷ বরং বরিশালের আশেপাশের অঞ্চলেই যুদ্ধ করেছেন৷ রণক্ষেত্রেই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ৷ ঝালকাঠি এলাকায় এক যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকেও হত্যা করে তাঁর দল৷ তিনি বলেন, ‘‘ঝালকাঠির পাশে বাউকাঠি নামক স্থানে আমরা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করি৷ সেখানে আমাদের নজরে পাঁচ-সাতজন মারা গেছে৷''
বর্বর নির্যাতন
সেই যুদ্ধে জয় পেলেও জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন বুলু৷ সঙ্গে ছিল আরো দুই সহযোদ্ধা৷ তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী৷ নির্যাতনের তীব্রতায় বুলু'র এক সঙ্গী প্রাণ হারায়৷ তবে প্রাণে বেঁচে যান বুলু৷ তিনি বলেন, ‘‘পাক হানাদাররা আটকের পর প্রথমে আমার মুখে কয়েকটি ঘুষি মারলো, পেটে মারলো৷ মারার পরে গৌরনদী কলেজের একটি রুমে নিয়ে আমাদের পায়ের তলায় পেটালো৷ ওরা বারবার আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য জানতে চেয়েছিল৷ আমরা বলিনি৷ তখন তারা আমার সমস্ত পিঠে এবং পায়ে বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করে৷ জোড়া থাপ্পর দিয়ে আমার কান ফাটিয়ে ফেলে৷''
হতাশ বুলু
পাক বাহিনীর নির্যাতনের পর তিন মাস জেল খাটেন বুলু৷ মুক্তি পান অক্টোবর মাসে৷ তখন তিনি প্রচণ্ড আহত, তবুও ফিরে যান যুদ্ধের ময়দানে৷ স্বাধীন বেশে বরিশালে ফেরেন ৮ ডিসেম্বর৷ মুক্তিযুদ্ধের পর টানা তিন বছর চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি৷ বর্বর নির্যাতনে তাঁর দৃষ্টিশক্তি অনেক কমে গিয়েছিল৷ হারিয়েছিলেন শ্রবণ শক্তি৷ চিকিৎসার পর খানিকটা সুস্থ হয়ে কিছুদিন চাকরি করেছেন৷ বর্তমানে বুলুর বয়স ৬৭ বছর৷ তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পরে বাঙালি চরিত্রের অবক্ষয় দেখে আমি হতাশ হয়েছি৷ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে না৷ মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, স্বার্থপরতা বেড়েছে৷ দেশপ্রেম কমে গেছে৷''
বুলু একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা৷ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে সুযোগসুবিধাও পাচ্ছেন তিনি৷ বুলু চান, বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক, অপরাধীর বিচার হোক৷
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক