বাংলাদেশের জন্য প্রাণবাজি রেখে লড়েছেন কাঁকন বিবি
৬ জুলাই ২০১১কাঁকন বিবির জীবন ইতিহাস বড় বিচিত্র৷ সবুজ অরণ্য আর পাহাড়-টিলা ঘেরা ত্রিপুরায় জন্ম তাঁর৷ বাবার নাম যিশো এবং মার নাম মিলি৷ পাহাড়ি অরণ্যে প্রকৃতির প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে বড় হন কাঁকন৷ ষোল-সতের বছর বয়সে শাহেদ আলী নামের এক মুসলমান তরুণের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর৷ পরে মুসলমান হয়ে নিজের নাম রাখেন নূরজাহান বেগম৷ বিয়ে করেন শাহেদকে৷ স্বামীর সাথে চলে আসেন সুনামগঞ্জে৷
পাঁচ-ছয় বছর না পেরোতেই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ৷ স্বামী শাহেদের অনুমতি না পেলেও দেশের স্বার্থে লড়াই করে বাঁচতে চান কাঁকন৷ ঘর-সংসার ছেড়ে যুদ্ধে যোগ দেন৷ প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির বাক্স, খাবার, ওষুধ-পত্র বহন ও পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন৷ কিন্তু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না কাঁকন বিবির লড়াই৷ পরে তিনি নানা ছদ্মবেশে পাক সেনাদের অবস্থান ও আক্রমণ পরিকল্পনার তথ্য সংগ্রহ করতেন৷ এমনকি বীরপ্রতীক তারামন বিবির মত তিনিও ভিখারির ছদ্মবেশে পাক সেনাদের শিবিরে এবং তাদের কাছাকাছি অবস্থানে হাজির হতেন৷ সেসব তথ্য যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন এই অকুতোভয় নারী৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন পাক সেনাদের সন্দেহের কবলে পড়ে যান তিনি৷ পাক সেনারা তাঁকে আটক করে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নানা নির্যাতন চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য পাওয়ার আশায়৷ অথচ সকল নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করেন কাঁকন৷
একদিন সুযোগ বুঝে পাক শিবির থেকে পালিয়ে আসেন এই ভাগ্যবতী নারী৷ সোজা চলে আসেন মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে৷ ঐ অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী সেখানে তাঁকে রান্নার কাজ করতে বলেন৷ ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত রান্নাবান্নার কাজ করেন তিনি৷ এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অভিযানে যোগ দিতে থাকেন৷ মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছর পর বেশ বৃদ্ধ এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সেসময়ের সাহসী তরুণী কাঁকন বিবি৷ স্মৃতি থেকে অনেক কিছুই গেছে হারিয়ে৷ ফলে এখন আর সবকথা ঠিকমতো স্মরণ করে গুছিয়ে বলতে পারেন না তিনি৷ ডয়চে ভেলের সাথে টেলিফোন আলাপে ভাঙা ভাঙা বাক্যে বললেন কয়েকটি কথা৷
মুক্তিযুদ্ধে কাঁকন বিবির সাহসী কর্মকাণ্ডের কথা বেশ অনেকদিন অজানা ছিল৷ দেশ স্বাধীন হলেও মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবিকে সেই আগের মতোই ভিক্ষা করে জীবন চালাতে হতো৷ তবে বিগত দশকে নারী প্রগতি সংঘ এবং দৈনিক মুক্তকণ্ঠের বরাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর অসীম সাহসিকতার পরিচয় জানতে পারে এই জাতি৷ লেখা হয় তাঁর সম্মুখ যুদ্ধসহ পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে নানা অভিযানে অংশ নেওয়ার ঘটনা৷ সেখান থেকে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কে জাউয়া বাজারে সেতু উড়িয়ে দেওয়া এবং পাক সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিযানে ছিলেন কাঁকন৷ এমনই প্রায় বিশটি অভিযানে অংশ নেন তিনি৷ এগুলোর মধ্যে পনেরোটিই ছিল পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ৷ এগুলোর মধ্যে অপারেশন মহব্বতপুর, কান্দিগাঁও, টেংবাটিনা, বেটিগাঁও, নূরপুর, দোয়ারা বাজার, টেবলাই এবং পূর্ববাজারের অভিযান উল্লেখযোগ্য৷
কাঁকন বিবির কর্মকাণ্ড এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ডয়চে ভেলেকে জানান তাঁর জামাতা রফিক মিয়া৷ তিনি বললেন, ‘‘পাক সেনারা যেভাবে বাংলাদেশের নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতো সেসব কিছুই তাঁকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে৷ প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা এবং পাক সেনারা কেউই তাঁকে বিশ্বাস করতো না৷ পরে অবশ্য তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নিজের সাহসী কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই ছদ্মবেশ ধারণ করে ভিখারি বেশে তথ্য সংগ্রহ করতেন৷ কিন্তু স্বাধীনতার পরও সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধার জীবনের অধিকাংশ দিন কেটেছে কষ্টের মধ্য দিয়ে৷ অবশ্য পরে দৈনিক জনকণ্ঠ এবং জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি সহযোগিতার ফলে কিছুটা ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন একাত্তরের এই সাহসী যোদ্ধা৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক