দেশে জাতিগোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, ঘৃণাবোধ গাঢ়ভাবে আছে
৫ জুন ২০২০ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন বর্ণবাদের সুগভীর মনস্তত্ত্ব৷
ডয়চে ভেলে : আমাদের দেশে কোন কোন ধরনের বর্ণবাদের উপস্থিতি দেখা যায়?
অধ্যাপক মানস চৌধুরী : বর্ণবাদের ক্যাটাগরি না বলে আমি এভাবে বুঝি, বর্ণবাদের শুরুটা বর্গীকরণ থেকে৷ মানুষকে শুধু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বা আন্দাজে শুধু ক্যাটাগরি করাই না, একটা স্ট্রাকচারাল বিদ্বেষ বহন করে সেটা৷ সেটা যদি আমরা ব্যবহারিক দিক থেকে একমত হই তাহলে ধরুন, জাতিগোষ্ঠীগত বিদ্বেষ ভীষণ কাঠামোগতভাবে আছে বাংলাদেশে৷ বিশেষ বিশেষ চেহারা বা আচরণকে নির্দিষ্ট করে ফেলা৷ শব্দ ব্যবহারেও ঝামেলা লাগছে, তবুও ধরুন ‘দেখতে চোরের মতো’, ‘চাঁড়ালের মতো’ এমন কতগুলো বর্গ আদর্শিকভাবে ঘৃণাত্মকভাবে ব্যবহৃত হয়৷ জাতিগোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, ঘৃণাবোধ গাঢ়ভাবে আছে৷ এর বাইরে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেও আছে৷ কোনো একটা অঞ্চলকে শনাক্ত করে, যেমন ধরুন ‘ওমুক এলাকার লোক ডাকাত’ বলা হচ্ছে৷ মূল কথা হলো একটা জনগোষ্ঠীকে সাধারণীকরণ করে সর্বাত্মক ধারাবাহিকভাবে কাঠামোগত বিদ্বেষ বহন করা৷ এটা বিশদভাবে বাংলাদেশে চালু আছে৷
আমাদের গণমাধ্যম কি বর্ণবাদকে উৎসাহিত করে? যেমন ধরেন সিনেমার নায়ক নায়িকাকে ফর্সা দেখিয়ে এমন কিছু?
আমি বর্ণবাদকে এত সরলীকরণ করে দেখি না৷ ওই যে চামড়া ফর্সা করার, বিশেষ করে নারীদের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বড় মার্কেট এবং বড়সড়ো প্রচারণা আছে৷ ফলে গণমাধ্যমকে দোষারোপের বাইরে রাখার সুযোগই নেই৷ এখন বর্ণবাদকে যদি আমরা এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করি তাহলে এর একটা বিপদজনক বাঁক আছে৷ তাহলে বর্ণবাদের ঐতিহাসিক পরিধি বা গভীরতা বা দুঃখজনক যে বিকাশ তাকে খুব লঘু করে ফেলতে পারি৷ এর মাধ্যমে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের দৌরাত্ম্য বা যারা ব্যবহার করছেন তার কোনটিকেই আমি খাটো করছি না৷ সামগ্রিক বর্ণবাদের আলোচনাকে ত্বকের রঙে সীমাবদ্ধ করা বিপদজনক হবে৷ গণমাধ্যমের দায় সেটা নানান জাতির মানুষকে ঘৃণাত্মক প্রকাশের মাধ্যমে হোক বা উপেক্ষার মাধ্যমেই হোক আর অন্য জাতি-গোষ্ঠীর উপস্থিতিকে অস্বীকার করার মাধ্যমেই হোক – এটা কিন্তু চলমান৷
ভাষায় কি আমরা বর্ণবাদী? প্রমিত বনাম আঞ্চলিক, শহর বনাম গ্রাম?
একটা কাঠামোগত ব্যবস্থাকে আমি বলছি বর্ণবাদ৷ তাহলে বলব যে, ভাষাতে সেটা আছে৷ কোন এলাকার উচ্চারণ বোঝাই যায় না, বা কোনটা শুনতে বিশ্রি – এগুলো তো আমরা নানা সময় জাজমেন্ট করতেই থাকি৷ আমার মনে হয়, প্রমিত বনাম আঞ্চলিকের যে তর্কটা সেটা আরেকটু কমপ্লিকেটেড৷ এটার একটা ভীষণ প্রাতিষ্ঠানিক দৌরাত্ম্য আছে৷ আমি যদি প্রমিত তর্কে নাও যাই তাহলেও সাধারণভাবে কতগুলো অঞ্চলের ভাষাকে কেবল কৌতুকের জন্য বা হাস্যরসের জন্য বা তামাশা দেখার জন্য ব্যবহার করা হয়৷ সেটা বিদ্বেষপ্রসূত বটে৷
পোশাকেও কি আমরা বর্ণবাদী? যেমন ধরেন লুঙ্গি বনাম প্যান্ট বা ওয়েস্টার্ন বনাম দেশি পোশাক এমন কিছু?
আমি তো কাঠামোগত বৈষম্যের কথা বললাম৷ আমরা পাঁচজনের মধ্যে একজন শব্দ করে চা খেলেই তো তাকে নিয়ে হাসি, তাই না? এগুলো যদি প্রসঙ্গ হয় তাহলে তো আছে৷ কিন্তু বর্ণবাদের একটা সরল লে-আউট বানাতে গিয়ে আমরা যেন তালিকা না করে বসি যে, আমরা পোশাকে বর্ণবাদী বা আমরা ভাষাতে বর্ণবাদী৷ তাতে বুঝতে অসুবিধা বাড়বেই শেষে৷
ঝাড়ুদার বা সুইপারদের সঙ্গে আমরা কি বর্ণবাদী আচরণ করি? তাদের জন্য তো আলাদা থাকার ব্যবস্থা৷ সমাজ থেকে কি তাদের একটু আলাদা করার চেষ্টা কি-না?
বর্ণবাদী বলি, আর বৈষম্যমূলকই বলি এটা তো অবধারিত যেভাবে এই পেশাগুলো তৈরি হয়েছে ঔপনিবেশিক কাল থেকে৷ এই সম্প্রদায়কে বিভিন্ন জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে নিয়ে আসা হয়েছে৷ সেটা চা বাগানের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে৷ বিভিন্ন অঞ্চলের গরিব মানুষদেরকে বলা যায়, একটা ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে, তাঁদের বিক্ষোভকে দমন করার জন্য এবং একইভাবে রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে অল্প পয়সায় কঠিন কাজগুলো করানোর জন্য, দীর্ঘকাল ধরে এই নিপীড়নটা তৈরি হয়েছে৷ তাদের রাখা হয়েছে একটা বিশেষ জায়গাতে৷ নিজেদের তৈরি-করা ভাষা ছাড়া তাদের যোগাযোগ প্রায় অসম্ভব৷ শুধু বসা ছোঁয়ার বিষয় তো বটেই, আমি বরং যোগ করব ঐতিহাসিক পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে এদের উপরে ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতা, শোষণ বিদ্যমান আছে৷ সেই কাঠামোটাও গুরুত্বপূর্ণ৷ আপনি আমি তাঁদের সঙ্গে পাশাপাশি বেঞ্চে বসলেও ২০০ বছর ধরে তাদের উপর চলা নির্যাতনের কাঠামোটা তো দূরীভূত হচ্ছে না৷
আবার বেদে সম্প্রদায় থাকে নদীতে৷ তারা ভাসমান৷ সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের অন্য চোখে দেখে৷ তাদের কিন্তু জায়গা জমিতে কোন অধিকার নেই৷ এটা কি বর্ণবাদ না?
আবারও বলব, যে বিষয়গুলো নানাভাবে বোঝার অবকাশ আছে সেখানে কিন্তু এটাও বর্ণবাদ, ওটাও বর্ণবাদ এভাবে বলার একটা রিস্ক আছে৷ বাংলাদেশে ছায়াছবিতে ছাড়া তাঁদের স্বাভাবিক উপস্থিতি খুবই সামান্য৷ মাঝে মধ্যে রাস্তাঘাটে তাঁদের ফেরি করতে দেখা যায়৷ এফডিসির ছায়াছবিতে তাঁদের যে উপস্থিতি এটা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেওয়াও খুব মুশকিল৷ বেদেদের একটা বড় অংশ জলবাসী ছিলেন৷ বাংলাদেশে এখন পানি কই? তারা যখন বাধ্য হয়ে ডাঙ্গায় আসছেন, অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, সেখানে কিন্তু বাঙালি গরিবদের মতো করেও শুরু করতে পারছেন না৷ গরিব বাঙালিরা যে সব জায়গায় শ্রম বিক্রি করতে পারেন তারা তো সে কাজগুলোতেও ঢুকতে পারছেন না৷ এই সম্প্রদায়গুলোর ক্ষেত্রে নিপীড়নের কাঠামোটা বহুমাত্রিক৷
সাদা-কালোর একটা দ্বন্দ্ব তো আছেই৷ এই উপমহাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে অনেক মনীষী তাদের উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থে কালোকে সুন্দর রূপ দিতে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন৷ কারণ আমরা কালো পছন্দ করি না৷ শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যেও রাধা-কৃষ্ণের মধ্যে কালোর সুন্দর বর্ণনা করা হয়েছে৷ এগুলো যদি একটু ব্যাখ্যা করেন?
আপনার মনে পড়বে, সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিটা৷ এখানে একটা চরিত্র ছিল সাঁওতাল৷ ভীষণ রোমান্টিসাইজড একটা চরিত্র৷ যে চরিত্রটা করানো হয় মুম্বাই থেকে এনে সিমি গাড়ওয়ালকে দিয়ে৷ তাঁকে একটা ডার্ক মেকআপ দিয়ে সাঁওতাল গাত্রবর্ণ তৈরি করা হয়৷ কলকাতার কয়েক তরুণের স্বপ্নের মধ্যে থাকা একটা তরুণী৷ এই চরিত্রটা করার জন্য একজন সাঁওতালকেও বাছাই করা হয়নি, যদি সেই ইতিহাস-রাজনীতি বিবর্জিত রোমান্টিসাইজড চরিত্রটিকে গ্রহণও করি৷ কিছুদিন আগে দেখেন হাসান আজিজুল হক স্যার একটা কমেন্ট করে এক ধরনের বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন৷ গায়ের রঙ ধরে উল্লেখ করতেও খারাপ লাগছে, তবুও বলি, চাকমা, মারমা তাঁদের গাত্রবর্ণ তো গড়পরতা বাঙালিদের থেকেও উজ্বল৷ আমি নিজেও এমন অভিজ্ঞতায় পড়েছি যেখানে সুপারশপে আমার সাথে থাকা মানুষটিকে বিক্রেতা যখন মনে করছেন কোরীয় বা জাপানি তখন তার যে আচরণ এবং যখন আবিষ্কার করলেন পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসা একজন তখন কিন্তু তাঁর আচরণ আকাশ-পাতাল তফাৎ৷ বর্ণবাদের গাত্রবর্ণের উৎস সকলেই জানি৷ সেটা আলোচনা করার কিছু নেই৷ বর্ণবাদের সুগভীর মনস্তাত্ত্বিক যে পাটাতন সেটা যদি আমরা অনুল্লেখ করে রাখি, বিপদ হতে পারে৷ বাঙালিরা যখন আফ্রিকার কমিউনিটির প্রতি বিদ্বেষ বহন করে সেটার সুনির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড আছে৷ গায়ের রঙ দিয়ে দেখতে থাকা ত্রুটিপূর্ণ দেখা হবে৷