1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দেশে দেশে বাড়ছে বর্ণবাদ, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি

৭ জুলাই ২০২৩

প্যারিসের শহরতলি নঁতেতে পুলিশের গুলিতে আলজেরীয় বংশোদ্ভুত এক কিশোরের মৃত্যুতে বর্ণবাদের বিষয়টি আবারো বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছে৷

https://p.dw.com/p/4TZqL
Deutschland | Köln | Black Lives Matter Protest
জার্মানির কোলন শহরে বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ৷ ফাইল ফটো৷ ছবি: Getty Images/A. Rentz

বছরের পর বছর ধরে অ্যামেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ক্রমেই বেড়ে চলেছে বর্ণবাদ৷ নিত্যদিনের জীবন, স্কুল থেকে বিপণি বিতান, এমনকি খেলার মাঠেও বাড়ছে বর্ণবাদী আচরণ৷

গত ২৭ জুন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নঁতে এলাকায় গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন নাহেল নামের ১৭ বছরের এক কিশোর৷ তাকে থামতে বলার পরও না থামায়, খুব কাছ থেকে গুলি করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷

গুলিবিদ্ধ নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি৷ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকেও আটক করা হয়েছে৷ কিন্তু ওই রাত থেকে বদলে যায় গোটা ফ্রান্সের দৃশ্যপট৷ ঘটনার প্রতিবাদে প্যারিসসহ দেশটির কয়েকটি শহরে শুরু হয় বিক্ষোভ ও সহিংসতা৷ টানা কয়েকদিন ধরে চলা এই সহিংসতা ঠেকাতে হাজারো পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি৷ গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় হাজার তিনেক বিক্ষোভকারীকে৷

বলা হচ্ছে, নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে৷

ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর দেশ জার্মানির চিত্রও ভিন্ন নয়৷ জার্মানিতে প্রতিদিন নিগ্রহ, অপমান এবং সূক্ষ্মভাবে লজ্জা দেয়ার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসীরা৷

জার্মানিকে একটি উদারপন্থী দেশ হিসেবে দেখা হয়৷ ২০২৩ সালে এসে তা আগের চেয়ে আরও উন্নত হয়েছে বলে মনে করেন জার্মানরা৷ বিশেষ করে ২০০৬ বিশ্বকাপের পর থেকে বলা হয় ‘জার্মানি আরও রঙিন হয়ে উঠেছে৷’

গত ১২ জানুয়ারি বর্ণবাদ নিয়ে জার্মান সরকারের প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদনে অবশ্য তার প্রমাণ মিলছে না৷প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জার্মানিতে বর্ণবাদ শুধু শারীরিক সহিংসতা ও মৌখিক আক্রমণের মধ্যেই আটকে নেই৷ বরং অভিবাসীরা স্কুলে, স্পোর্টস ক্লাবে, বাড়ি খোঁজার সময়ে, কর্মস্থলে, এমনকি পুলিশের কাছেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷

বছরের পর বছর এই সমস্যাকে উপেক্ষা করার প্রবণতার অবসান দাবি করেছেন জার্মানির প্রথম বর্ণবাদবিরোধী নারী কমিশনার রিম আলাবালি-রাডোফান ৷ তিনি বলেন, ‘‘বর্ণবাদ একটি বিমূর্ত ধারণা নয়, আমাদের সমাজের অনেক মানুষের জন্য একটি বেদনাদায়ক এক বাস্তবতা৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘বর্ণবাদ গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি, কারণ, এটা মানুষ এবং তাদের মানবিক মর্যাদাকে আঘাত করে, যা মৌলিক আইন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে৷''

বর্ণবাদের শিকার মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি জার্মানিতে প্রকাশিত হয়েছে ‘পিপল অব ডয়েচলান্ড’ নামে একটি বই৷ এটির সম্পাদক মার্টিনা রিঙ্ক বলেন, ‘‘বর্ণবাদ এমন এক কূটাভ্যাস, যা যে কেউ করতে পারেন, যে কেউ শিকার হতে পারেন৷ এমন ব্যক্তিরাও বর্ণবাদী আচরণ করতে পারেন, যিনি আপনাকে সত্যিকার অর্থে পছন্দ করেন৷ তারা হয়তো খেয়ালই করে না, কখন তারা আপনাকে আঘাত করে ফেলল৷’’

বইটি প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ক্রিয়েটিভ ম্যানেজার সাইমন ইউসিফো বলেন, ‘‘বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি পদক্ষেপ নেয়া বইটির লক্ষ্য নয়, বরং সবার মধ্যে যে কুসংস্কার রয়েছে, সেটা পাঠকদের জানা দরকার৷ কারণ, আমরা এভাবেই সামাজিক হয়েছি৷ এর মধ্য দিয়ে বর্ণবাদী আচরণগুলোকে চেনা যায় এবং তা দূর করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা যায়৷''

২০২২ সালের ২৯ জুলাই নাইজেরিয়া থেকে ইটালিতে আসা আলিকা ওগোচুকভু নামের এক অভিবাসীকে পিটিয়ে হত্যা করে এক শেতাঙ্গ ইটালিয়ান৷ দেশটির সিভিতিনোভা মারসে শহরে রাস্তায় হকারের কাজ করতেন এই অভিবাসী৷

ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপে নিহতের স্ত্রী বলেছিলেন, তার স্বামী বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন৷ তার গায়ের রং কালো বলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে৷ এসময় কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার রক্ষায় ইটালির অভিবাসন আইনের সংস্কার আনারও দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷

বর্ণবাদী আচরণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও৷ গত বছর গ্রিক দ্বীপ থেসালোনিকির কাছে পেরিয়া নামের একটি এলাকায় অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের একটি ভবনে একাধিকবার বর্ণবাদী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে৷

২০২০ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশটির সমাজে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়৷

গেল বছরের মে-তে যুক্তরাষ্ট্রের বাফালোর একটি সুপারমার্কেটে ঢুকে ১৮ বছরের এক তরুণ গুলিতে আহত হন মোট ১৩ জন৷ যার মধ্যে ১১ জনই কৃষ্ণাঙ্গ৷ এর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ ওই অঞ্চলটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত৷ গুলি চালানো ওই তরুণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়, হোয়াইট সুপ্রিমেসি মাথায় রেখেই কাজটি করা হয়েছে৷

ইউরোপে অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা গেছে৷ রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের পর লাখো ইউক্রেনীয়দের ইউরোপের বিভিন্ন দেশ স্বাগত জানালেও অন্য দেশের অভিবাসীদের প্রতি কঠোর অবস্থানের দেশগুলোর সরকার৷ সম্প্রতি গ্রিস উপকূলে নৌকা ডুবে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটনায়ও দেশটির উপকূলরক্ষীদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ তোলা হয়েছে৷

খেলার মাঠেও বর্ণবাদ

ফুটবল ঘিরে বর্ণবাদ যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কিছুদিন আগেই ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়াস জুনিয়রের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ নিয়ে উত্তাল হয়েছিল ফুটবলাঙ্গন৷ ২২ বছর বয়সি এই ফুটবলার এ নিয়ে চার বার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হলে খেলার মাঠে৷

তার রেশ না কাটতেই আবারো বর্ণবাদী আচরণের শিকার হলেন আরেক ব্রাজিলিয়ান৷ ৩১ মে আর্জেন্টিনায় অনূর্ধ্ব ২০ ফুটবল বিশ্বকাপের টিউনিশিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল৷ কিন্তু প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে জার্সি টেনে ফেলে দেয়ায় ১৯ বছর বয়সি ডিফেন্ডার রেনানকে লাল কার্ড দেখান রেফারি৷

কিন্তু রেনানের লাল কার্ড ছাপিয়ে এখন আলোচনায় বর্ণবাদ৷ ম্যাচের পর সাইবার স্পেসে বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন জেনিত সেইন্ট পিটার্সবার্গের এই তরুণ তারকা৷

গত ১৯ জুন নিউজিল্যান্ড ও কাতারের মধ্যকার আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচটি বাতিল হওয়া নিয়েও তদন্তে নেমেছে ফিফা৷ একইদিনে কুয়েত অনূর্ধ্ব-২২ ও আয়ারল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলের বাতিল হওয়া ম্যাচ নিয়েও তদন্ত করবে বৈশ্বিক এই ফুটবল সংস্থা৷ এই দুটি ম্যাচ নিয়েই বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ রয়েছে৷

কেন এই বর্ণবাদ, সমাধানে পথ কী?

গত ৩ জুলাই রাতে টিউনিশিয়ার উপকূলীয় শহরে স্ফ্যাক্সে স্থানীয়দের সঙ্গে সাব-সাহারা আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সংঘর্ষের মধ্যে ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন এক টিউনিশ নাগরিক৷ তার মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিন অভিবাসীকে আটক করেছে দেশটির পুলিশ৷ এ ঘটনায় শত শত অভিবাসীকে টিউনিশিয়া ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে৷

অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশটি অভিবাসীদের ওপর গত ফেব্রুয়ারি থেকে বেশ চড়াও হয়েছেন৷ অভিবাসীরা বলছেন, তারা সেখানে বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন৷ কারণ ফেব্রুয়ারিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ টিউনিশিয়ার জনমিতি পরিবর্তন এবং অপরাধের জন্য অভিবাসীদের দায়ী করেন৷ তারপর থেকেই পুলিশি হয়রানি, দেশের জনগণের হাতে নিগৃহীত হতে থাকেন অভিবাসীরা৷ অনেকে টিউনিশিয়া ছেড়ে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন৷

বিশ্লষকেরা বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান এবং তাদের ক্ষমতায় আসার কারণে প্রচ্ছন্নভাবে বর্ণবাদী আচরণ বাড়ছে৷ বিশেষ করে ইউরোপের দেশ ইটালি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরির সরকারগুলোর অভিবাসী বিরোধী কট্টর অবস্থানের কারণে সমাজে চাপা পড়ে থাকা বর্ণবাদ বেরিয়ে আসছে৷

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের সরকার অভিবাসীর বিরুদ্ধে এমন কট্টর অবস্থানে রয়েছেন যে দেশটি সফর করতে বাধ্য হয়েছেন রোম ও ভ্যাটিকান সিটির বিশপ পোপ ফ্রান্সিস৷ গত ৩০ এপ্রিল বুদাপেস্ট সফর করে অভিবাসীদের জন্য দুয়ার খুলে দিতে হাঙ্গেরির জনগণের প্রতি আহ্বান জানাতে হয়েছে তাকে৷

এসব সমস্যা সমাধানে সমাজে বিরাজমান বর্ণবাদকে দূর করতে হবে বলে মনে করেন ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট রেসিজমের জ্যেষ্ঠ গবেষক ওজেয়াকু ভাবজু৷ সমাজকে নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবার পাশাপাশি পুনর্গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি এমন নয় যে, বর্ণবাদ আমাদের সমাজে প্রোথিত আছে৷ বরং আমরা এটি সমাজে তৈরি করেছি এবং আমরাই তা দূর করতে পারি৷’’

বর্ণবাদ রোধ করতে জাতীয় পর্যায়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির দাবি জানান তিনি৷ সেই সঙ্গে সতর্ক করে তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তন খুব সহসা নাও আসতে পারে৷ 

ওজেয়াকু ভাবজু বলেন, ‘‘তবে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি৷ আমার মনে হয়, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন সামাজিক-প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি একটি সুযোগ৷ তারা আইন প্রণয়নের জন্য সুশীল সমাজের সদস্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে এমন সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে পারে৷’’

এই গবেষকের সঙ্গে একমত সাউথ আফ্রিকার উইটওয়াটার্সরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসন গবেষক কুদুস আদেবায়ো৷ ডয়চে ভেলেক তিনি বলেন, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে তার জন্য প্রতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন৷ বর্ণবাদ দূর করতে হলে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান