ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উর্বর ভূমি
৩০ অক্টোবর ২০২০মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি তার প্রমাণ৷ যুক্তি দেওয়া যেতেই পারে যে, বাঙালি মননে ধর্ম অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বলেই মুসলিম লীগ বিলীন হয়ে গেছে৷ জামায়াতের রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রভাব কমে গেছে৷ সাদা চোখে এ যুক্তি বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে৷ কিন্তু একটু চিন্তা দিয়ে পর্যবেক্ষণ বা সমাজ বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন বাস্তবতা দৃশ্যমান হতে পারে৷ ‘হতে পারে’ বলছি একারণে যে,নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি আসলে কখনও বিশ্লেষণই করা হয়নি৷ অগ্রসর শিক্ষিত শ্রেণী, যারা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সমাজ চিন্তক লেখক তাদের থেকে সমাজ বিশ্লেষণ প্রত্যাশিত ছিল৷ তাদের থেকে বিশ্লেষণটা কখনও আসেনি৷ এর একটি কারণ হয়ত এই যে,যাদের থেকে এই বিশ্লেষণ আসতে পারত-তাদের আমরা ১৯৭১ সালে হারিয়েছে৷ পাকিস্তানিরা দেশীয় জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সহায়তায় তালিকা করে তাদের হত্যা করেছে৷ এও খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সমাজ চিন্তক মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার ঠিক আগে দিয়ে৷ যখন পাকিস্তানিরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে,তখনই তাদের হত্যা করা হয়৷ বাংলাদেশ যাতে জ্ঞানভিত্তিক অগ্রসর চিন্তার দেশে পরিণত হতে না পারে, লক্ষ্য ছিল সেটাই৷ কোনো সন্দেহ নেই যে, তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে৷ বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছে৷ পরাজিত পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির শীর্ষ জ্ঞানের দিশারিদের হত্যা করে চিন্তাজগতকে অন্ধকার করে দিয়ে গেছে৷ সেই অন্ধকারকে আলোকিত করা যাদের দায়িত্ব ছিল, তারা সেই অন্ধকার দূর করতে পারেনি৷ শিক্ষক-চিন্তক শুন্য স্থানে যারা দৃশ্যমান হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের চিন্তাজগত বিস্তৃত ও দিকনির্দেশনা সমৃদ্ধ ছিল না৷ ছিল না তাদের চিন্তার গভীরতা৷ তাদের চিন্তাজগতের সংকীর্ণতার মূল্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে৷
মুক্তিযুদ্ধের পরের স্বাধীন বাংলাদেশে দাড়ি-টুপিকে রাজাকার-আল বদর-আল শামসের সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ গল্প-উপন্যাস,নাটক-সিনেমা সর্বত্র ব্যবহার করা হয়েছে৷ একথা সত্যি যে,জামায়াতে ইসলামী ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করেই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ করেছিল৷ জামায়াতের নেতা গোলাম আযম, নিজামীরা দাড়ি-টুপিধারী ছিল৷ রাজাকারদেরও অনেকের দাড়ি-টুপি ছিল৷ দাড়ি-টুপি ছাড়া রাজাকারও ছিল৷
দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় জামায়াত-রাজাকারের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য৷ জামায়াত-রাজাকারদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক দাড়ি-টুপি পরিহিত বা ধর্ম পালন করা মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন৷ অধিকাংশ তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বাবা-চাচা-দাদা ছিলেন দাড়ি-টুপি পরিহিত ধর্ম পালনকারী৷ স্বাধীন দেশে রাজাকার ‘ঘৃণা’ শব্দে পরিণত হবে,সেটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু দাড়ি-টুপিকে ঘৃণ্য রাজাকারের সিম্বলে পরিণত করাটা ছিল চূড়ান্ত রকমের অদূরদর্শী কর্ম৷যা বাংলাদেশের নাটক সিনেমায় বছরের ধরে করা হয়েছে৷ এই জায়াগাটিতে কোনো দুরদর্শী দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বুদ্ধিজীবী চিন্তক শ্রেণী৷ তারাও এই স্রোতে গা ভাসিয়েছেন৷ তারা একদিকে প্রগতিশীলতার কথা বলে ইসলাম ধর্ম পালন বিষয়ে উন্নাসিকতা দেখিয়েছেন৷ আবার সংস্কৃতির কথা বলে অন্য ধর্ম পালনের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন৷ তাদের এই স্ববিরোধী আচরণ দেশের মানুষ দেখেছেন৷ ফলে জনমানুষ থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন৷ তারা কথা-লেখা-কাজ দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি৷
এরই পরিণতিতে ধর্মাশ্রয়ে রাজনীতির উর্বর ভূমি পেয়েছে সামরিক শাসকেরা৷ জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামীকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিএনপি৷ ধর্মের ব্যবহারে রাজনীতিও করেছে৷
এরশাদ আরেক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করেছে৷ খালেদা জিয়া জামানায় জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে৷
এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল সমাজ-নির্মাণের রাজনীতি করেছে বামধারা ও আওয়ামী লীগ৷ বামধারা বইয়ের ভাষায় কথা বলে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে৷ বাম নেতাদের অনেকে ক্ষমতার মোহে আওয়ামী লীগে আশ্রয় খুঁজেছে৷ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ৷ যুদ্ধাপরাধের বিচারের মত প্রায় অবিশ্বাস্য কর্মটিও সম্পন্ন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার৷
আবার বিষ্ময়কর হলেও সত্যি, আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে তার নিজের নীতি পরিত্যাগ করে সামরিক শাসকদের নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে৷ হিজাব পড়েছে, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে, মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চালানোর বক্তৃতা করেছে৷ হেফজতের সঙ্গে আপোষ করেছে৷পাঠপুস্তক সাম্প্রদায়িকরণ করেছে৷ এখন সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনসটিটিউট হিজাব ও টাকনুর উপর কাপড় পরিধানের নির্দেশ জারি করছে৷ শোকজ হচ্ছে,নির্দেশ প্রত্যাহারও হচ্ছে৷ কিন্তু নির্দেশ জারির যে মনোজগত, তা তো থেকেই যাচ্ছে৷ এই মনোজগতই নাটক-সিনেমায় কবুল বলা যাবে না,আইন করতে চাইছে৷
বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়ে নীতি থেকে সরে এসেছে৷এই যুক্তি সঠিক হলে আওয়ামী লীগের সমর্থন বা ভোট বাড়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷ আওয়ামী লীগের যে কমবেশি ৩৮ শতাংশ ভোট, তা বাড়েনি৷
ভোটারবিহীন ও রাতের নির্বাচন বিবেচনায় নিয়ে হিসেব করছি না৷ নীতি ত্যাগের ফলশ্রুতিতে ভোট না বাড়লেও বা কমলেও, ক্ষমতায় থাকতে পারছে৷ বাহিনী-প্রশাসন ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া-থাকা সামরিক শাসকদের নীতি৷ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিও সামরিক শাসকদের নীতি৷ সামরিক শাসকদের গড়া দলের মত, আওয়ামী লীগও তা করছে৷ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিতে কে কতটা এগিয়ে সেই প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে অংশগ্রহণকারী সবাই, বামধারা বাদে৷ ফলে ক্রমান্বয়ে মুক্তচিন্তা-মুক্তবুদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক বক্তৃতায় দেশে এগিয়ে গেলেও, অগ্রসরমান চিন্তাধারায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে৷
২০১৬ সালের ছবিঘরটি দেখুন...