চাই সচেতনতা, চাই প্রতিরোধ
১৪ ডিসেম্বর ২০১৪কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ, দিল্লি ছাড়া যে ১০টি শহরে ইন্টারনেট-ভিত্তিক এই ক্যাব বুকিং সংস্থাটির পরিষেবা রয়েছে, সেখানে উবার-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক৷ কিন্তু উবার-কে দেশের সর্বত্র নিষিদ্ধ করলেই কি ভারতের অগুনতি নারী সুরক্ষিত হবেন? হবেন না৷
কার্যত যে দেশে প্রতি ২২ মিনিটে একজন সাবালিকা বা নাবালিকা যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে, সেখানে একটা কোম্পানিকে ‘ব্যান' করলেই ‘ধর্ষণের নগরী' দিল্লির ‘লজ্জা' দূর হতে পারে না৷
প্রশ্ন হলো, ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লির সেই পাশবিক গণধর্ষণকাণ্ডে মেডিকেল ছাত্রী ‘নির্ভয়া'র ধর্ষণ এবং হত্যার পরও রাজ্যের পরিবহণ ব্যবস্থা নারীকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম কেন?
সে সময় বেসরকারি বাস অপারেটররা আন্দোলনে নেমেছিলেন, আজ প্রাইভেট কার অপারেটররা রাস্তায় নামবেন, মিছিল করবেন৷ শুধু সরকারি বাস চললে শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়বে৷ তাই সরকার নিজেদের দায় এড়াতে, শহরের নিরাপত্তা, নারী স্বাধীনতা এবং তার দায়বদ্ধতা থেকে বাঁচতে অন্যের ওপর দোষ দেবে, মেয়েদের বাড়ি থেকে বের হতে অথবা ‘আধুনিক পোশাক' পরতে বারণ করবে, হয়ত বা কিছু লোককে গ্রেপ্তারও করবে৷ কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না৷
আম আদমি পার্টির মুখপাত্র, আমার এক সময়কার অধ্যাপক-বন্ধু যোগেন্দ্র যাদব টুইটারে যেমনটা লিখেছেন, ‘‘উবার-কে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে৷ কিন্তু তাই বলে আমাদের ভেরিফিকেশন-ব্যবস্থা, নিয়ম-নীতিগুলোর মধ্যে যে ফাঁক রয়ে গেছে, আমাদের পুলিশ-প্রশাসনও যে অনেক ক্ষেত্রে অক্ষম – সেটা ভুলে গেলে চলবে না৷''
সত্যিই তো৷ তা না হলে যে ড্রাইভার যৌন হয়রানি, বেআইনি অস্ত্র রাখা, ডাকাতি এবং ধর্ষণের মতো মামলার আসামি, যার গাড়িতে জিপিএস ব্যবস্থা ছিল না, যার মোবাইল ফোনটা ছিল বেনামে, যার কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়নি, এমনকি যে চালকের দিল্লি ট্রান্সপোর্ট দপ্তর থেকে লাইসেন্সও ইস্যু করা ছিল না, মহানগরীর রাস্তায় সে গাড়ি চালায় কীভাবে?
কীভাবে উবার-এর মতো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা মুখে নিরাপদ সেবার আশ্বাস দিলেও চালক বা ড্রাইভার নিয়োগে কোনোরকমের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি? আমি হতবাক! আরো অবাক এ খবরটা পড়ে যে, এ ঘটনার মাত্র ১০ দিন আগে ধর্ষক শিব কুমার যাদবের বিরুদ্ধে উবার-এর কাছে একটি আভিযোগ আসে৷ অভিযোগটি করেছিলেন নিধি শাহ৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমি ২৬শে নভেম্বর দিল্লিতে শিব কুমার যাদবের ট্যাক্সিতেই উঠেছিলাম৷ এখন এ কথাটা ভাবলেই আমার গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷....ড্রাইভারটা আমার দিকে খুব খারাপভাবে তাকিয়ে হাসছিল৷ তখনই আমার লোকটাকে সুবিধের মনে হয়নি৷''
না, নিধির অভিযোগে কানই দেয়নি উবার, সাহিল মেঘনানির টুইট থেকেই সে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়৷
তবে শুধু উবার কেন? ভারতের বেশ কয়েকটি কার অপারেটরই এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সরকারি নিয়ম মেনে চলছে না৷ এই যেমন, ভারতে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো বেআইনি৷ কিন্তু কোন কোন শহরে ক'টা ড্রাইভারের লাইসেন্স যাচাই করা হয়?
বেশিরভাগ বেসরকারি ট্যাক্সির ‘অল ইন্ডিয়া/স্টেট পার্মিট' থাকলেও শহরে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই৷ কিন্তু যারা এটা মানছে না, তাদের চিহ্নিত করার কোনো নির্দিষ্ট উপায় আছে কি?
সুপ্রিম কোর্টের আইন অনুযায়ী, ক্যাব বা ট্যাক্সিকে ‘ক্লিন ফুয়েল' ব্যবহার করতে হবে৷ অথচ বেশিরভাগ ট্যাক্সিই কিন্তু এখনও ডিজেলে চলছে৷
বলতে চাইলে অনেক কিছুই বলা যায়৷ কিন্তু আসল কথা হলো ভারতে আইন যেমন আছে, আইনের ফাঁকও তেমন আছে৷ তাই এ অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী?
কিন্তু শুধুমাত্র অপরাধীকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিলেও যে সমাজের এই ক্যানসারকে সারিয়ে তোলা যাবে না৷ অনেকেই হয়ত বলবেন, বিশ্ব মিডিয়ায় একটার পর একটি ধর্ষণের খবর ভারতের জন্য, পর্যটনের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক৷ ঠিক কথা৷ কিন্তু ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, মানব পাচার – এ সব ঘৃণ্য ঘটনাকে সর্বসমক্ষে তুলে না ধরা, লোকলজ্জার ভয়ে গোপন করা অথবা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া – তা সে ব্যক্তিই হোক অথবা সরকার – এতে কোনো ফল হবে না৷
বরং সুশীল সমাজকে আরো অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে, প্রতিটি নাগরিককে তার অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে৷ প্রয়োজনে আঙুল তুলতে হবে সরকারের দিকে৷ প্রশ্ন করতে হবে – কেন দেশের ‘হেল্পলাইনগুলো' কাজ করছে না? কীভাবে পুলিশ-প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে একটার পর একটা ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে চলেছে? কী করে নিকৃষ্টতম অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ আমলা-মন্ত্রী-অপরাধীরা? আর এ সবের সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রতিরোধ, মিডিয়াকে সঙ্গে রেখে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে হবে আমাদেরই৷