ধাক্কা লাগলেও সামাল দেয়ার ক্ষমতা ভারতের আছে
১৫ জুলাই ২০২২রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের প্রভাব যেখানে অ্যামেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যের উপর ভয়ংকরভাবে পড়ছে, তখন ভারত যে বাদ যাবে না, এই সরল সত্যটা বুঝতে খুব বড় কোনো অর্থনীতিবিদ বা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই৷ তার প্রভাব পড়ছে, না পড়লেই আশ্চর্য হতে হতো৷ তবে পাশাপাশি এটাও সত্যি, ইউরোপ বা অ্যামেরিকা যতটা প্রবলভাবে যুদ্ধের ধাক্কা অনুভব করছে, ভারতে এখনো ততটা অনুভূত হচ্ছে না৷
যুদ্ধের ঠেলায় যখন বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বাড়তে শুরু করলো, তখন ভারতে পেট্রোল, ডিজেলের দাম বাড়েনি৷ উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন চলছিল, তখন কি আর তেলের দাম বাড়তে পারে! এমনিতে ভারতের পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজি-র দাম এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে, দেশেও পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়বে৷ সেভাবেই বাড়ে৷ তবে ভোটের সময় অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে সেই দাম বাড়ে না৷ পরে অবশ্য যখন বাড়তে থাকে, তখন সুদে-আসলে উসুল করে নেয়া হয়৷
আবার আন্তক্জাতিক বাজারে তেলের কমে গেলে, পেট্রোল, ডিজেলের দাম কমে না৷ তখন কর, শুল্ক সব বেড়ে যায়৷ তো সেইসব গোলমেলে অঙ্কের ভিতর না ঢোকাই ভালো৷ ভোটের ফলাফল বেরোনোর কিছুদিন পর থেকে শুরু হলো পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়া৷ প্রায় প্রতিদিন৷ দিন ষোলো ধরে লাগাতার বেড়েছিল বোধহয়৷ শেষের দিকে মানুষ আর গোণা বন্ধ করে দিয়েছিল৷ পেট্রোলের দাম ১০৫ টাকা ছাড়িয়ে গেল, ডিজেলও সেঞ্চুরি করে ফেললো৷ তারপর সরকার সদয় হয়ে শুল্ক কম করায় এখন দিল্লিতে পেট্রোল লিটারে ৯৬ টাকার সামান্য বেশি দামে বিক্রি হয়৷ রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম অবশ্য এক হাজার টাকা ছাড়িয়েছে৷
যুদ্ধের পরপর বিশ্বের বাজারে তেলের দাম যে জায়গায় পৌঁছেছিল, এখন তার থেকে অনেকটাই কমেছে৷ ফলে পেট্রোল-ডিজেলের দাম আরো বেশ কিছুটা কম হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু গোল বেঁধেছে টাকার দাম নিয়ে৷ দিনের পর দিন টাকার দাম কমছে৷ ফলে তেল কেনার খরচ বেড়ে গেছে বলে সরকারের কাছেও দাম না কমানোর অজুহাত চলে এসেছে৷ আর পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়া মানে তো সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া৷ এমনিতেই যুদ্ধের বাজারে সব দেশই টের পাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি কাকে বলে৷
তবে এক্ষেত্রেও ভারতের একটা সুবিধা আছে্৷ তারা রাশিয়া থেকে সস্তায় প্রচুর তেল পাচ্ছে৷ সস্তা মানে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দামে ভারতকে তেল দিচ্ছে রাশিয়া৷ ৬৬ থেকে ৭০ শতাংশ ডিসকাউন্টে৷ সাধে কি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে এসে বলেছিলেন, ঢাকাও সস্তায় তেল কিনতে চায়, সেজন্য তারা ভারতের সাহায্য চায়৷ ভারত যেভাবে পশ্চিমা দেশের চাপ অগ্রাহ্য করে তেল কিনে যাচ্ছে, সেটা ছোট দেশ বলে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়৷ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যামেরিকা, ইউরোপে গিয়ে একটা সরল, সত্যি কথা বলেছেন৷ ইউরোপ এখনো রাশিয়া থেকে একদিনে যে তেল-গ্যাস কেনে, ভারত এতদিনেও সেই পরিমাণ তেল কিনতে পারেনি৷ তাই ভারতের উপর চাপ দেয়ার আগে নিজেদের দিকে একটু দেখে নেয়া ভালো৷
ভারতে এখন মুদ্রাস্ফীতির হার সাত শতাংশের সামান্য বেশি৷ অ্যামেরিকা, জার্মানির তুলনায় কম৷ এতদিন যে দেশগুলি মুদ্রাস্ফীতি বলে কিছু জানত না, বছরের পর বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম একই থাকত, তারা এখন টের পাচ্ছে, উপমহাদেশের মানুষের যন্ত্রণা৷ আমরা তো জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জেনেছি, জিনিসের দাম বাড়বে৷ কখনো বেশি, কখনো কম৷ আলু এখন ৪০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হলেও মানুষের মনে খুব একটা হেলদোল নেই৷ কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই তা কমে যাবে৷
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, বিশ্বব্যাংক মনে করছে, মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও ভারতের গরিবদের উপর তার প্রভাব পড়ছে না৷ তার কারণ, করোনাকাল থেকে গরিবরা সরকারের কাছ থেকে বিনা পয়সায় রেশন পায়৷ এখন কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্য সরকার মিলে গরিবদের রেশন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, গরিব ভাতার মতো প্রচুর প্রকল্প হাতে নিয়েছে৷ ফলে দাম বাড়লেও তার আঁচ গরিবদের উপর সেভাবে পড়ে না৷ তার উপর তাদের একশ দিনের কাজের গ্যারান্টিও আছে৷
যুদ্ধের আবহাওয়া, ইউরোপে মন্দার আশঙ্কা, ঘরের পাশে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তানের আইএমএফের সাহায্যে কোনোক্রমে অর্থনীতি সামলানোর চেষ্টার প্রভাব কি ভারতের উপরও এসে পড়বে না?
আশঙ্কাটা একেবারে নেই তা নয়, আবার এটাও সত্যি ভারতীয় অর্থনীতির হাল অতটাও খারাপ নয়৷ ভারতের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ৬২ হাজার কোটির বেশি৷ চিন্তার বিষয় একটাই৷ সেটা হলো ভারতের বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ৷ তবে চলতি আর্থিক বছরে সেই ঋণ মিটিয়েও বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে খুব বেশি টান পড়বে না৷ ফলে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো অবস্থা অন্তত অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই৷
আবার সব খারাপ জিনিসের একটা ভালো দিকও থাকে৷ ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়লেও, পাউন্ড ও ইউরোর তুলনায় অতটা পড়েনি৷ টাকার দাম পড়ে যাওয়াটা যেমন খারাপ, তেমনই আবার এই সুযোগে রপ্তানি বাণিজ্য লাভের মুখ দেখছে৷ আর ভারত কৃষিক্ষেত্রে অনেকটাই স্বনির্ভর৷ অল্প কিছু জিনিস বাদে ভারতকে খাদ্যশস্য নিয়ে অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না৷
করোনার কারণে দুই বছর জনজীবন প্রায় স্তব্ধ থাকার পর এখন দেশের অবস্থা স্বাভাবিক৷ কাজকর্ম, বিক্রিবাটা আগের মতো হচ্ছে৷ রাস্তাঘাট, শপিং মল, বাজার গমগম করছে৷ গরমে দিল্লির আশপাশের জায়গাগুলিতে, বিশেষ করে পাহাড়ে হোটেলে একটা ঘরও খালি ছিল না৷ রাশিয়া-ইউক্রেন, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান, চীন সবই ঠিক আছে, তার বিরূপ প্রভাব থাকলেও তা ভারতের কাছে ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি৷ ভারতের আমজনতার এখন একটাই প্রার্থনা, আবার করোনার মতো কিছু যেন না আসে, যা ঘরবন্দি করে দেবে মানুষকে, নাড়িয়ে দেবে অর্থনীতিকে, মানুষ চাকরি হারাবে, খেতে পাবে না৷ এটা বাদে এখনো পর্যন্ত যা অবস্থা, তাতে ধাক্কা লাগলেও তা সামলে নেয়ার ক্ষমতা ভারতের আছে৷