ভারতে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
২৯ জুন ২০১৭ভারতে গরু জবাই সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার আগে থেকেই ছড়াতে শুরু করেছিল বিদ্বেষ৷ যাঁরা গরুর মাংস খান, তাঁরা আদতে হিন্দু ধর্মের শত্রু— এমন এক বিকৃত, বিদ্বেষী ধারণা ক্রমশই জোরদার করে তোলা হচ্ছিল দেশের বিভিন্ন অংশে৷ উত্তরপ্রদেশের মোহাম্মদ আখলাখকে পিটিয়ে মারার ঘটনা আজও দগদগে ক্ষতের মতো হয়ে আছে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের শরীরে৷ আখলাকের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল বড় বিচিত্র৷ তারা আখলাকের রান্নাঘর থেকে মাংসের নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক পরীক্ষা করিয়েছিল এটা নিশ্চিত করতে যে, ওটা আদতে কীসের মাংস ছিল৷ না, প্রমাণ হয়নি ওটা গরুর মাংস ছিল৷ কিন্তু যদি প্রমাণ হতো? তা হলে কি একজন মানুষকে পিটিয়ে মারা বৈধতা পেয়ে যেতো? স্রেফ সে গরুর মাংস খাচ্ছিল বলে!
এর পর সারা দেশ জুড়েই গো-হত্যা নিষিদ্ধ করার সরকারি ফরমান ওই উগ্রবাদী অপশক্তিকেই যে আরও উৎসাহিত করেছে, তার প্রমাণ গত সপ্তাহে জুনায়েদ খানের হত্যা৷ ঈদের বাজার করে বাড়ি ফিরছিল জুনায়েদ৷ ভাই এবং পরিবারের লোকেদের সঙ্গে৷ প্রথমে তাঁদের ‘গোখাদক’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ বলে গালি-গালাজ করা হয়৷ তার পর শুরু হয় প্রবল মারধর৷ একটা সময় ছুরি দিয়ে কোপানো হয় ১৬ বছরের জুনায়েদকে, ফেলে দেওয়া হয় চলন্ত ট্রেন থেকে৷ বুধবার পর্যন্ত চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে এই ঘটনায়, যাদের একজন দিল্লির সরকারি কর্মী৷ খোঁজ চলছে পঞ্চমজনের, যে জুনায়েদকে ছুরি মেরেছিল৷
দেশের নাগরিক সমাজ অত্যন্ত বিচলিত হয় এই ঘটনায়৷ এতদিন নানা পর্যায়ে, টিভিতে বলে, খবরের কাগজে লিখে যার প্রতিবাদ চলছিল, এবার সেটাই নেমে আসে রাজপথে৷ সাবা দেওয়ান নামে এক তথ্যচিত্র পরিচালক প্রথম ডাক দেন, বুধবার সন্ধেয় দিল্লির যন্তরমন্তরে নীরব প্রতিবাদে সামিল হতে৷
নাইন ইলেভেনের পর অ্যামেরিকার শান্তিকামী মানুষ যে যুদ্ধবিরোধী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই ‘নট ইন আওয়ার নেম’-এর ছায়ায় পরবর্তীতে ‘নট ইন মাই নেম’ শিরোনামে বেশ কিছু আন্দোলন চাঙ্গা হয়৷ সেই ‘নট ইন মাই নেম’ আবারও পুনরুজ্জীবিত হয়, হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিরোধী নাগরিক প্রতিবাদের নয়া মন্ত্র৷ স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেওয়া, এই সন্ত্রাস, এই হত্যায় আমার সায় নেই, আমি নেই ওই দলে, আমার নামে যেন এই অপরাধ বৈধতা না পায়৷ নট ইন মাই নেম৷
দিল্লি ছাড়াও পাটনা, পুণে, লখনউ, এলাহাবাদ, চণ্ডীগড়, জয়পুর, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কোচি, অর্থাৎ দেশের সব বড় শহরে এবং কলকাতায় বুধবার ধ্বনিত হয়েছে এই প্রতিবাদ৷ কলকাতার সমাবেশের যিনি অন্যতম উদ্যোক্তা, সেই শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত জমায়েতের আগে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন, যাঁরা শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারছেন না, তাঁরাও কবিতা পাঠিয়ে, লিখিত বক্তব্য পাঠিয়ে এই প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন৷ আর বুধবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এই সমাবেশে অন্তত হাজার খানেক মানুষকে দেখা গেল, যাঁরা এসেছেন বিবেকের তাগিদে৷ লেখক, কবি, শিল্পীরা ছাড়াও ছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত'র মতো বিশিষ্টরা, যারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পক্ষে সরব হয়েছিলেন৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তাঁরা হাজির থাকলেন আগাগোড়া৷
সোশ্যাল মিডিয়াতেও এদিন ভারতের অন্যান্য শহরের এই প্রতিবাদ সমাবেশের স্বতস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত চেহারা দেখা গেছে৷ সব ধর্মের মানুষ যেখানে এগিয়ে এসে বলেছেন, এই সাম্প্রদায়িক হিংসা আর বিদ্বেষ চলবে না৷ নট ইন মাই নেম!
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...