1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘নতজানু সাংবাদিকতা দেখে প্রধানমন্ত্রীর বিচলিত হওয়ার কথা’

১ জুলাই ২০২২

সম্প্রতি উদ্বোধন হল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু৷ এই সেতুর উদ্বোধন ঘিরে দেশের সংবাদ মাধ্যম যেভাবে খবর ছেপেছে তাতে কী অতিরঞ্জন ছিল? দেশের গর্বের এই সেতুর চেয়ে কি সরকার বা সরকারের প্রধানের গুণগান বেশি হয়েছে?

https://p.dw.com/p/4DVOA
Bangladesch | Eröffnung der längste Brücke in Bangladesch
ছবি: Press Information Department of Bangladesh/PID

এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের কাছে নিজের অভিব্যক্তির কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন৷

ডয়চে ভেলে: পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে মিডিয়ার ভূমিকা আপনার কাছে কেমন লেগেছে?

অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন: বাংলাদেশের কথা যখন আমরা মনে করি, ১৯৭১-১৯৭২ সালের কথা আমাদের দেশকে বলা হত তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই সময় থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে৷ পদ্মা সেতুকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য জায়গার যে সমস্ত রিপোর্ট হয়েছে, তখন যেভাবে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে এমনকি বিরোধী দলও যেভাবে

তাচ্ছিল্য করেছে সবকিছু মিলিয়ে এই অর্জনটাকে আমি দেখি নিজের সেতু৷ সেই অর্থে সেতুটা ভালো সেতু৷ সেটার জন্য মানুষের উচ্ছ্বাস থাকবে, ভালোবাসা থাকবে সেটা স্বাভাবিক৷ মিডিয়ার উচ্ছ্বাসও খারাপ কিছু না৷ কিন্তু এখন সরকারি দলের তোষামোদ করা, প্রধানমন্ত্রীর তোষামোদ করা একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে৷ বেশিরভাগ গণমাধ্যমই পরিমিতির জায়গাটা রাখতে পারেনি৷ সাংবাদিকেরা প্রধানমন্ত্রীকে যে ভাষায় তোষামোদ করে কথা বলেছেন সেই ল্যাঙ্গুয়েজটা সাংবাদিকতার সঙ্গে যায় কিনা সেটা ভেবে দেখবার মতো বিষয়৷ জাতীয় গর্বকে যে পেশাগত ভাষায় উদযাপন করা যায় সেই জায়গাটা তারা অতিক্রম করে গেছেন৷ অনেকেই মনে করতে পারেন, এখানে যতটা না উচ্ছ্বাস বা জাতীয় গর্বকে উদযাপন করা, তার চেয়ে বেশি ছিল সরকারি দল, প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যকে অনেক বেশি মাত্রায় তোষামোদির পর্যায়ে চলে গেছে৷  

‘সাংবাদিকতা কম্প্রোমাইজ হলে আর সাংবাদিকতা থাকে না’

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দু'এক দিন গুরুত্ব কম দিয়ে শুধুমাত্র পদ্মা সেতু নিয়েই মিডিয়ার এই আগ্রহকে আপনি সঠিক বলে মনে করেন কিনা?

সত্যি কথা বলতে কি, আমি মনে করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা পিছিয়ে দেবেন। বন্যাদুর্গত মানুষ পানিতে ভাসছে, মানুষ প্রিয়জনকে খুঁজে পাচ্ছে না, বাড়িঘর তলিয়ে গেছে, তখন আমি মনে করেছিলাম সরকার এটাকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করবে এবং যখন জাতীয় দুর্যোগ চলে তখন নিশ্চয় পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে কথা হবে না৷ এটা আনন্দের বিষয় তো, ফলে দু'এক মাস পিছিয়ে দিলে ক্ষতি হতো না৷ আমার কাছে খারাপ লেগেছে এই কারণে যে, একদিকে পদ্মা সেতুর ঝলমলে আলো, অন্যদিকে মানুষের হাহাকার৷ এই জিনিসগুলো আমরা সংবাদপত্রে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷ এটা ঠিক মানবিক না৷ বন্যার্ত মানুষ যারা রিলিফের জন্য হাত পেতে আছেন তাদের পক্ষে তো পদ্মা সেতুর এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব না৷ ফলে দেশের একটা অঞ্চলের মানুষের এই উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগই রইল না৷ এই পরিস্থিতিতে জমকালোভাবে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা দৃষ্টিকটু লেগেছে৷ সরকার চাইলেই এটা পিছিয়ে দিতে পারত৷ আর গণমাধ্যমও এই ব্যালান্সটা রাখতে পারেনি৷ বন্যার যে কাভারেজ সেটা হয়ে গেছে নিয়ম রক্ষা করার মতো একটা ছোট নিউজ৷

মিডিয়ার এই আচরণকে সরকার বা সরকারের প্রধানকে খুশি করার কোন প্রবণতা বলে মনে করেন?

শুধু খুশি করা না, তার চেয়েও বেশি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে৷ এটা নিয়ে কিন্তু অনেক প্রশ্ন করা যেত৷ যেমন, যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল সেটা কিভাবে সামলালেন? গঠনমূলক প্রশ্ন করা যেত এবং বিষয়গুলো সেভাবে নিয়ে আসা যেত৷ শুধু এই ঘটনা না, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ থেকে আসেন সেখানে প্রশ্ন উত্তরে না গিয়ে তৈলমর্দনের পর্বে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটাকে সাংবাদিকতা বলে না৷ আমার দৃষ্টিতে এটা সাংবাদিকতা না৷ প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে ইন্টেলিজেন্ট এবং বিচক্ষণ একজন মানুষ৷ ফলে আমার মনে প্রশ্ন জাগে উনার কি ভালো লাগে? এই ধরনের নতজানু সাংবাদিকতা দেখে তার ভয় হওয়ার কথা৷ একটা দেশে সাংবাদিকেরা সরকারের প্রধানের কাছে এত নতজানু হলে সরকার পরিবর্তন হলে অন্য আরেকদল সাংবাদিক আরেকজনের কাছে নতজানু হবেন৷ পেশাদারত্ব তো থাকল না৷ একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি বিচক্ষণ এবং দেশকে ভালোবাসেন এই নতজানু সাংবাদিকতা দেখেতার বিচলিত হবার কথা ৷ এটা আসলে সাংবাদিকতা বলে আমার মনে হয় না৷

যে কোন প্রকল্পের তো পজেটিভ দিক যেমন থাকে, কিছু নেতিবাচক দিকও থাকে৷ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে শুধুমাত্র পজেটিভ খবরগুলো পেলাম৷ কিন্তু মিডিয়ার কি দায়িত্ব ছিল না, নেতিবাচক কোন দিক থাকলে সেটাও প্রচার করা?

সেই কথাই তো বললাম, এখানে যে পরিমাণ অর্থ দিয়ে এটা শেষ করার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ লেগেছে৷ নানা সময় আমরা দেখেছি, দুর্নীতির প্রসঙ্গ এসেছে৷ এই দুর্নীতিটা কোন পর্যায়ে হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যেত, কেন এত বেশি খরচ হল সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা যেত, আল্টিমেটলি আমাদের কি কি লাভ হবে এমন নানা বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা যেত৷ যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে সেটা নিয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইতেই পারতেন৷ এ বিষয়ে তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থাকতে পারতো৷ অন্তত কমেন্ট্রি থাকতে পারতো৷ এর কোনটাই আমরা দেখিনি৷ ফলে আমার মনে হয়, যখন সাংবাদিকতা কম্প্রোমাইজ হয়ে যায় সরকারি দলের সঙ্গে তখন তো আর সাংবাদিকতা থাকে না৷ সাংবাদিতা না থাকলে যেটা হয়, সেটাই হয়েছে৷

এবার তথ্য অধিদপ্তর থেকে সার্কুলার জারি করে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নিয়ে টানা পজেটিভ নিউজ করতে হবে৷ আগে কি কখনও আপনি এমন সার্কুলার দেখেছেন?

আমার আসলে জানা নেই, এমন হওয়া সম্ভব৷ গণতান্ত্রিক প্রবাহ যখন ব্যহত হয়, বিশেষ করে যখন সামরিক সরকার আসে বা একদলীয় কোন সরকার আসে তারা চূড়ান্তভাবে সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিউজের কথা বলে দেয়৷ এছাড়াও গণতান্ত্রিক আমলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা হয় এই নিউজ যাবে, এটা যাবে না৷ কিন্তু যদি বলা হয় পদ্মা সেতু নিয়ে শুধুমাত্র ইতিবাচক খবর করতে হবে তাহলে সেটা দুঃখজনক৷ এর আগে এমন বিষয় আমি শুনিনি৷

সাংবাদিকদের কম্প্রোমাইজের কথা বলছিলেন, একটু বিস্তারিত বলবেন?

আমার কাছে মনে হয় সাংবাদিকেরা নিজেরা অনেক বেশি কম্প্রোমাইজ করে ফেলছেন৷ এটা হওয়াটাও স্বাভাবিক৷ কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তার আগে ছিল আইসিটি এ্যাক্ট৷ বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে যেটা হয়েছে, একটা কথা এদিক-ওদিক হলেই ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয় আছে৷ ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দারুণভাবে ব্যহত হয়েছে৷ এর বাস্তব উদাহরণও আমরা দেখেছি৷ এটা বাকস্বাধীনতার উপরও বড় আঘাত৷ ২০১৮ সালে সম্পাদক পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, এই আইনটা হলে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হবে৷ সেই ভয়ের সংস্কৃতি থেকে 
সাংবাদিকেরা নিজেদের কথা আর নিজেরা বলতে পারবেন না৷ নিজেরাই আসলে সেন্সরশিপ আরোপ করবেন৷ ঠিক সেই কাজটি এখন হয়েছে৷ বিশেষ করে সাংবাদিক নেতারা যারা আছেন, সংবাদপত্রের মালিকানায় যারা আছেন তারা ব্যবসাও করছেন আবার সরকার দলীয় রাজনীতিও করছেন৷ তারা একেবারেই কোন কথা বলেন না৷ ফলে বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা খুবই সংকটের মুখে৷ একদিকে কর্পোরেট হাউজের দৌরাত্ম্য আরেকদিকে আইনের ফাঁদে পড়া, এই দুটো মিলে যেটা হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই৷ আর এর জন্য সাফার করছেন সাংবাদিকেরা৷ এই সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা বলাই যায়৷ এখানে আমরা কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেখি না৷ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে কথা বার্তা খুব একটা বলা হয় না৷ যখন কোনো মন্ত্রীর কোন বিষয় সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় তার অনেক পরে মেইনস্ট্রিমের সাংবাদিকেরা দু'একটা কথা বলে বটে, কিন্তু এটা ঠিক সাংবাদিকতা বলে আমরা জানি না৷ ফলে আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যত খুবই অনিশ্চিত৷

মালিকপক্ষ বা সাংবাদিকেরা কি নিজেরাই নানা সুবিধার কারণে কি সেল্ফ সেন্সরশীপ করছেন? 

আমরা বড় বড় সাংবাদিকদের কথা জানি, সন্তোষ গুপ্ত, জহুর হোসেন চৌধুরী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সাররা যে জীবন যাপন করতেন আর এখনকার সাংবাদিকদের জীবনযাত্রার পার্থক্য করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব৷ খুব বেশিদিন সাংবাদিকতা করেনি, কয়েক বছর সাংবাদিকতা করেই নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার কথা শুনি৷বসুন্ধরা গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, তাদের হাত থেকেই যখন সারাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা পুরস্কার নিয়ে নিচ্ছেন তখন তাদের পক্ষে তো আর ওই বিষয়ে অনুসন্ধান করা সম্ভব না৷ এটা একটা উদাহরণ মাত্র৷ আরেকদিকে রয়েছে সরকার৷ এর ফলে সাংবাদিকতা ভয়াবহভাবে কম্প্রোমাইজড হয়৷ সরকারি দলের লোকেরাই ব্যবসা করছেন, তারাই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন৷ তার মানে মালিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ তিন এক হয়ে গেছে৷ ফলে এর মধ্যে পড়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাটা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান