‘নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষকরা’
২৪ নভেম্বর ২০২৩বাংলাদেশে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালু হওয়ার পর থেকে বিতর্ক থামছে না৷ যারা এই কারিকুলাম তৈরি করেছেন তারা এর পক্ষে বললেও শিক্ষক-অভিভাবকদের একটা বড় অংশ এর বিরোধিতা করছেন৷ অনেকেই নবম ও দশম শ্রেণিতে বিভাগ তুলে দেওয়ার সমালোচনা করেছেন৷ বিতর্কের মধ্যে নতুন কারিকুলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম৷
ডয়চে ভেলে : নতুন এই কারিকুলামের কাজ কবে থেকে শুরু হয়েছে?
অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম : ২০১৭ সালের মূলত চাহিদা নিরুপণ ও বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়৷ প্রয়োজন কী? বর্তমানে অবস্থা কী? এ নিয়ে মোট ছয়টি গবেষণা হয়েছে৷ এরপর ২০২১ সালে এসে একটা রূপরেখা তৈরি করেছি৷ এটা প্রিপ্রাইমারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত৷ এটা করার সময় অনেক বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, সভা-সেমিনার কথা হয়েছে৷
তারপর একটা রূপরেখা দাঁড় করানো হয়৷ এটা প্রধানমন্ত্রীকেও দেখানো হয়েছে৷ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেখেছে৷ রূপরেখার দু'এক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী সংশোধন দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেওয়ার পর কারিকুলাম অনুমোদনের জন্য সচিবের নেতৃত্বে সর্বোচ্চ কমিটি ন্যাশনাল কমিটি ফর কারিকুলাম কোডিনেশন (এনসিসিসি) অনুমোদন দেয়৷
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সকলের উপস্থিতিতে এটা তুলে ধরা হয়৷ কিছু মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনের পর এটা পাশ করা হয়েছে৷ এটার নাম জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১৷ এর উপর ২০২২ সালে ৬০টি স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়৷ এর ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই প্রবর্তন করেছি৷ ২০২৪ সালে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই প্রবর্তন করা হবে৷ ২০২৫ সালে দশম শ্রেণি, ২০২৬ সালে যাবে একাদশ শ্রেণি আর ২০২৭ সালে যাবে দ্বাদশ শ্রেণির বই৷ এই রূপরেখায় কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে৷ নাইনের পরীক্ষা নাইনেই হয়ে যাবে৷ এসএসসি পরীক্ষা শুধু দশম শ্রেণির কিছু নির্বাচিত বিষয়ের উপর হবে৷ এতে পাবলিক পরীক্ষার চাপ কমে যাবে৷ একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা একাদশ শ্রেণিতেই ফাইনাল হয়ে যাবে৷ আর দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণিতেই হবে৷ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত রেজাল্ট এইচএসসির রেজাল্ট হিসেবে গণ্য হবে৷ ক্লাস নাইন টেনে আর বিজ্ঞান, বাণিজ্য বলে কিছু থাকবে না৷ সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে৷ একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে তারা শাখা ভিত্তিক পড়াশোনা করবে৷
এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ কী?
এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ কিন্তু শিক্ষার্থীরা না৷ শিক্ষার্থীরা অনেক আনন্দের সঙ্গে এটা গ্রহণ করেছে৷ তাদের পড়াশোনার যে ভীতি বা পরীক্ষার যে ভীতি সেটা এখন আর নেই৷ তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে৷ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের শিক্ষকেরা৷ তারা কোন পরিবর্তন গ্রহণ করতে অভ্যস্ত না৷ শুধু এই কারিকুলাম পরিবর্তনের সময় না, তারা সব সময় একটা বাধা ছিলেন৷ তারা অভ্যস্ততার ভিত্তিতে ক্লাস নিতে পছন্দ করেন৷ তারা সব সময় বলেন আগেরটাই ভালো ছিল৷ তারা যে কোন পরিবর্তনে যেন অস্বস্তিতে পড়েন৷ এবারও তাই৷ তারা পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে চাচ্ছেন না৷ আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল, এদেশে নোট গাইডের একটা বিশাল ব্যবসা আছে৷ এই ব্যবসায়ীরা এটার সফলতার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন৷ আবার অনেক অভিভাবক ভাবছেন, পরীক্ষার খাতায় লেখা নেই, ফাস্ট, সেকেন্ড নেই এ আবার কেমন পরীক্ষা৷ তারাও আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ৷
শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়৷ তারা আন্দোলনেও মাঠে নেমেছেন৷ তাদের এই বক্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
তারা ভুল পথে আছেন৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা সম্ভব নয় বলে কী আমরা পেছাতেই থাকব৷ আমাদের তো শুরু করতে হবে৷ অবশ্যই যে কোন শুরুতে কিছু সমস্যা থাকতে পারে৷ এটার কারণে যদি আমরা পিছিয়ে থাকি, তাহলে তো আমাদের শিক্ষার্থীরা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে যেতে পারবে না৷ তারা তো পৃথিবীর অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে পারবে না৷ আপনি তো জানেন, দুনিয়াদারির একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে৷ এটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গেলে আমাদের এই শিক্ষাক্রমের কোন বিকল্প নেই৷
বলা হচ্ছে, এই কারিকুলামে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে৷ কিন্তু শিক্ষকদের অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে৷ এতে করে শিক্ষকেরা কী শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অর্থ উপার্জনের একটা সুবিধা নিতে পারেন না?
কথাটা তো কিছুটা সত্যি৷ প্রত্যেকটা ব্যবস্থারই তো একটা বিকল্প থাকে৷ ইতিবাচকভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং তারাই সারা বছর যে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন তাদের যাতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারে এজন্য শিক্ষকদের হাতে কিছু নম্বর বেশি দেওয়া হয়েছে৷ আরেকটা বিষয় হল, এতদিন আমরা পেপার পেন্সিলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে পারতাম৷ কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি বা ভ্যালুজের মূল্যায়ন করতে পারতাম না৷ এটার মূল্যায়ন করতে পারেন একজন শিক্ষক কাছ থেকে দেখার মাধ্যমে৷ একটা ছেলেকে না দেখে তো আপনি তার খাতা দেখে মূল্যায়ন করতে পারেন না৷ খাতা দেখে কী লিখেছে সেটার মূল্যায়ন করা সম্ভব৷ নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা পারদর্শিতার মূল্যায়ন করতে চাচ্ছি৷ উদাহরণ দিয়ে বলি, ওজুর ফরজ কত প্রকার ও কী কী? এটা সে মুখস্ত বলত৷ এটার তো দরকার নেই৷ সে যদি ওজু করে দেখাতে পারে তাহলে বুঝব যে তার যোগ্যতা অর্জন হয়েছে৷ সে পূর্ণমার্ক পাবে৷
কোন কোন দেশের কারিকুলাম দেখে এই কারিকুলাম বানানো হয়েছে?
শিক্ষা নিয়ে যে বড় বড় দেশ যেমন ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্টেলিয়াসহ ইউরোপীয় অনেক দেশের কারিকুলাম দেখা হয়েছে৷ পাশাপাশি জাপান, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তানের কারিকুলামও দেখা হয়েছে৷
এই দেশগুলোর শিক্ষকদের মান, শিক্ষা বাজেট বা শিক্ষা অবকাঠামো কী বাংলাদেশের সঙ্গে মেলানো সম্ভব?
আমি বলছি না যে, মেলানো সম্ভব৷ আমরা কিন্তু ওদের মতো করে হুবহু নিয়ে এসেছি তা কিন্তু না৷ আমরা বলছি, থিংক গ্লোবালি, এ্যাক্ট লোকালি৷ অর্থাৎ গ্লোবালি চিন্তা করব, কিন্তু দেশের সীমাবদ্ধ সম্পদ, অবকাঠামোর মধ্যে আমরা ডিজাইন করেছি৷ আমরা কিন্তু ইউরোপ থেকে ধার করে পুরোপুরি চালিয়ে দিচ্ছি, বিষয়টি এমন না৷
এখন পর্যন্ত কত ভাগ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে?
আগের শিক্ষাক্রমগুলোকে শিক্ষাক্রম চালু করার পর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এবার আগে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তারপর কারিকুলাম চালু করা হয়েছে৷ গত বছর আমরা নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রশিক্ষণ দিয়েছি তারপর জানুয়ারিতে চালু করেছি৷ এবারও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে৷ সবাই প্রশিক্ষণের আওতায় আসবে৷
সৃজনশীলতা বিকাশে আসলেই কী এই কারিকুলাম বিশেষ কোন ভূমিকা রাখবে?
মূলত সৃজনশীলতা বিকাশের জন্যই এই কারিকুলাম৷ মুখস্ত পদ্ধতির পরিবর্তে সে নিজে নিজেই করবে৷ শিক্ষার্থীরা মুখস্ত না করে যদি নিজে কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে তো তার সৃজনশীলতার তো অবশ্যই বিকাশ ঘটবে৷