নাগরিক অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে খারাপ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ
৬ ডিসেম্বর ২০২৩জোহানেসবার্গ ভিত্তিক নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী সিভিকাস মনিটর বুধবার প্রকাশিত তাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে যেসব দেশে এই মুহূর্তে নাগরিক অধিকার সবচাইতে সংকুচিত, বাংলাদেশকে সেরকম ২৮টি দেশের কাতারে রেখেছে৷ সিভিকাসের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এশিয়ায় এধরনের দেশের সংখ্যা আগে ছিল সাতটি - আফগানিস্তান, চীন, হংকং, লাওস, মায়ানমার, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম৷ নতুন করে এদের কাতারে যোগ হয়েছে বাংলাদেশ৷
সিভিকাস মূলত নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির একটি বৈশ্বিক জোট৷ সারা বিশ্বের ১৭৫টি দেশে অনেকগুলো সংস্থা ও প্রায় ১৫ হাজার অধিকার কর্মী তাদের নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত৷ দেশে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য নাগরিক সমাজের পদক্ষেপকে শক্তিশালী করতে এসব ব্যক্তি ও সংস্থা কাজ করে৷ নাগরিক অধিকারকে বিঘ্নিত করে এমন সব ঘটনাবলীকে তারা নথিভুক্ত করে এবং এ নিয়ে গবেষণা করে৷
সংস্থাটি নাগরিক অধিকারের উপর বিধিনিষেধ ও আক্রমণ নথিভুক্ত কাজটি শুরু করে মূলত ২০১৮ সালে৷ পাঁচটি ক্যাটাগারিতে দেশগুলোকে বিভক্ত করে সিভিকাস৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম থেকেই, অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকেই চতুর্থ সর্বনিম্ন ধাপ "রেস্ট্রিকটেড" ক্যাটাগরিতে৷ ক্রম অবনতিশীল অধিকার পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশকে তারা বিশেষ দৃষ্টিবদ্ধ দেশগুলোর তালিকায়, অর্থাৎ ওয়াচ লিস্টে রাখে৷ আর ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে তারা শেষ ধাপ অর্থাৎ "ক্লোজড" ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেয়৷ এই অবনমনের কারণ হিসেবে তারা মূলত ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং স্বাধীন সমালোচকদের উপর সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়নকে উল্লেখ করেছে৷
"পিপল পাওয়ার আন্ডার অ্যাটাক ২০২৩" শীর্ষক প্রতিবেদনে ১৯৮টি দেশের নাগরিক অধিকার পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে৷ প্রতিবেদনটিতে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সার সংক্ষেপ তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার রক্ষাকারীদের টার্গেট করেছে, সাংবাদিক, বিক্ষোভকারী এবং অন্যান্য সমালোচকদের নানা উপায়ে ভীতি প্রদর্শন করছে৷ তারা নানা ধরনের সহিংসতা, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
সুশীল সমাজের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন এবং তাদের তহবিল ও কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ, সরকার কর্তৃক মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অধিকারের দুই মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিন এলানকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা, নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি এবং সাম্প্রতিক মাস গুলোতে বিরোধী দলের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গ্রেপ্তার, সাংবাদিকদের হয়রানি, নজরদারি, নির্যাতন ও শারীরিক হামলা সহ তাদের কাজের জন্য টার্গেট করার ঘটনাওগুলোকেও নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিভিকাস৷
সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস, অধরা ইয়াসমিন ও রঘুনাথ খাঁ'র হয়রানি ও নির্যাতনকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে সিভিকাস মন্তব্য করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, পরিবর্তিত নতুন আইন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ তার অনেক কিছুই রয়ে গেছে৷
"যদিও বছরের পর বছর ধরে আমরা শেখ হাসিনার শাসনামলে নাগরিক স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ দেখেছি কিন্তু ২০২৩ সালে এই লঙ্ঘন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে," বলে মন্তব্য করেছেন সিভিকাসের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় গবেষক জোসেফ বেনেডিক্ট৷ শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সম্ভব সবকিছু করছেন বলে মন্তব্য করে জোসেফ আরো যোগ করেছেন, " বর্তমান পরিবেশে কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়৷"
বাংলাদেশ সরকারকে নিপীড়নের পথ থেকে সরে আসার দাবি জানানোর পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷ "বিশ্ব নেতাদের অবিলম্বে কারাবন্দী বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি জানাতে হবে এবং তাগিদ দিতে হবে যাতে সরকার সব রাজনৈতিক দলকে সত্যিকার অর্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়,"- বলেছেন তিনি৷
বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নাগরিক অধিকার খর্ব করার এসব অভিযোগ সরকার বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে৷ তবে সিভিকাসের এসব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন দেশের কয়েকজন স্থানীয় কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক গোষ্ঠী৷ "সবচেয়ে যেটা দুঃখজনক, এটা যে, দেশ একটা স্বৈরশাসনের মধ্যে পতিত হয়েছে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে৷ তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের একটা বৃহৎ অংশ নির্বাচনের উপরে, প্রশাসনের উপরে, সত্যতার উপরে, খবরের উপরে তাদের সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলছেন," বলেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল৷
আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার উদাহরণ হিসেবে তিনি বিরোধীদের চলমান আন্দোলনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো উল্লেখ করেছেন৷ অগ্নিসংযোগের যেসব ঘটনা ঘটছে, এর কতগুলো সাজানো, এবং কতগুলো সাজানো নয়, বোঝা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসবের দায় যেভাবে বিরোধী দলের কথিত দুর্বৃত্তদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে. তাতে তাদের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না৷ "এখন আপনি দুর্বৃত্তদের ধরতে পারছেন না, শনাক্ত করতে পারছেন না, তাহলে কি করে হবে, মানুষ কেমন করে বিশ্বাস রাখবে যে দেশে আইন শৃঙ্খলা আছে৷ এই পরিস্থিতিতে মানুষ আসলেই আস্থাহীন হয়ে পড়ছে এবং বাংলাদেশে মানবাধিকারের অবস্থান, বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার সব কিছুই আজকে বিঘ্নিত হয়ে গেছে, এটা হচ্ছে আমার বিশ্বাস," বলেছেন ফারুখ ফয়সল৷
প্রায় একই ধরণের মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার৷ "অনেকগুলো মানবাধিকার সংস্থা, কমবেশি একই বিবৃতি দিচ্ছে... সুশীল সমাজের স্থান সংকুচিত হচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে এবং একই সাথে আমাদের অনেক নাগরিক অধিকার সংকুচিত হচ্ছে৷ নির্বাচনের আগে যে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে তা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, এটি আরও খারাপ হবে কি না তা এখন দেখার বিষয়,"- বলেছেন তিনি৷
বাংলাদেশ ছাড়া ও এবছর ভেনেজুয়েলার নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি সর্বনিম্ন ধাপে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সিভিকাস৷ আরো যেসব দেশে পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, জার্মানি, কিরগিজস্তান, সেনেগাল ও শ্রীলঙ্কা৷ বাংলাদেশ সহ যে ২৮টি দেশে নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি সবচাইতে খারাপ, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০.৬ শতাংশই এই সব দেশে বসবাস করে বলে সিভিকাস তাদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে৷ আর যেসব দেশে নাগরিক অধিকার পরিস্থিতি সবচাইতে উন্মুক্ত তাতে বসবাস করে মাত্র ২.১ শতাংশ মানুষ, যা একই সঙ্গে নির্দেশ করে নাগরিক অধিকার সংকোচনের এই বিষয়টি কেবল কিছু নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, বরং প্রাপ্ত উপাত্ত একটি বৈশ্বিক সংকটকেই চিহ্নিত করে৷