নারী সাংবাদিককে ‘চরিত্রহীন' বলে মইনুল কারাগারে
২৩ অক্টোবর ২০১৮টক শো-তে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে রংপুরে একটি মানহানির মামলা দায়ের করেছেন একজন নারী মানবাধিকারকর্মী৷
এর আগেও তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা হয়েছে৷ সবগুলোতেই জামিনে ছিলেন তিনি৷ সোমবারের ওই মানহানির মামলায় রাতেই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ৷ এই মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাকে (ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন) কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) কায়সারুল ইসলামের আদালতে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বিচারক৷
রংপুরে মামলাটি করেছেন মানবাধিকারকর্মী মোছাম্মৎ মিলি মায়া৷ যে ঘটনায় তিনি সরাসরি জড়িত নন, সেই ঘটনায় তাঁর মামলায় উদ্যোগী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘একজন নারীর প্রতি যে অসম্মান করা হয়েছে, এ কারণেই একজন নারী হয়ে আমি এই মামলা করেছি৷ মইনুল হোসেন যে অসম্মান করেছেন মাসুদা ভাট্টিকে, সেটা তার একার অপমান না৷ সেটা পুরো নারী সমাজের অপমান৷'' কয়েকদিন আগের ঘটনা এত পরে এসে কেন মামলা করলেন? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আপনি কি উৎসাহিত হয়ে মামলাটি করেছেন? এসব প্রশ্নের জবাবে মিলি মায়া বলেন, ‘‘এখানে কারো বক্তব্যে আমি উৎসাহিত হইনি৷ নিজের সিদ্ধান্তে মামলা করেছি৷ মামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে দেরি হয়েছে৷ আমি মনে করি, তার এমন শাস্তি হওয়া উচিৎ যাতে আর কেউ কোনো নারীকে অসম্মান করে এভাবে কোনো বক্তব্য দিতে না পারে৷''
বিচারকের আদেশের পরপরই ব্যারিস্টার মইনুলকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল আলম জানান, ‘‘তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে সাধারণ বন্দিদের মতো রাখা হবে৷'' মইনুল হোসেনের পক্ষে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জামিন শুনানির শুরুতে বলেন, ‘‘স্যার, (বিচারক) মামলাটি কী এবং কোন ধারার মামলা, আমাদের কাছে কিছুই নেই৷'' তিনি বলেন, ‘‘স্যার, (বিচারক) আপনাকে আগে জানতে হবে এটা কী মামলা, জামিনযোগ্য ধারার, নাকি জামিন অযোগ্য ধারার৷জামিনযোগ্য ধারার হলে একরকম, আর জামিন অযোগ্য ধারার হলে আরেক রকম আদেশ দেবেন৷'' তখন বিচারক বলেন, ‘‘এটা রংপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মামলা, যার নম্বর ৭৯৭, দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার মামলা৷''
এরপর আসামি মইনুল হোসেনের পক্ষে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের কাছে জানতে চান, মইনুলের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা আছে কিনা৷ এখানে অন্য থানার প্রসিকিউশনের পুলিশ দেখা যাচ্ছে৷ বিচারক বলেন, ‘‘না৷ ওনার বাসা ওয়ারি থানার এলাকায় হওয়ায় ওই থানার পুলিশ আছে৷ বাকিরা নিরাপত্তার জন্য৷'' সানাউল্লাহ মিয়া শুনানিতে আরো বলেন, ‘‘এ মামলার আসামি মইনুল হোসেনের পক্ষে শুনানি করবেন তার আপন মামা খন্দকার মাহবুব হোসেন৷ তবে এ মামলাটি একটি সিআর মামলা, বাদী মিলি মায়া বেগম৷ উনি মামলা করেছেন রংপুরে৷ মামলার ঘটনাস্থল হলো ঢাকা৷ ওইখানে তো বাদির কোনো মানহানি হয়নি৷ মাননীয় আদালতের কাছে আমরা জামিন চাই৷ যেহেতু তাকে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, সেহেতু জামিনযোগ্য ধারায় তাকে জামিন দেওয়া আদালতের এখতিয়ার রয়েছে৷''
ঘটনার সূত্রপাত একাত্তর টেলিভিশনের টক শো ‘একাত্তর জার্নাল'-এ৷ সেখানে ব্যারিস্টার মইনুলের কাছে মাসুদা ভাট্টি জানতে চান, তিনি জামায়াতে ইসলামীর হয়ে জোটে অংশ নিচ্ছেন কিনা৷ মাসুদা ভাট্টি জানান, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিওকে কেন্দ্র করে এমন একটি আলোচনা চলছে৷ কিন্তু প্রশ্নরে জবাব না দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল মাসুদাকে ‘চরিত্রহীন' হিসেবে আখ্যায়িত করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷ পরের দিন মাসুদা ভাট্টিও মামলা করেন মইনুলের বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬টি মামলা হয়েছে সাবেক ত্ত্বাবধয়ারক সরকারের উপদেষ্টার বিরুদ্ধে৷ ৫টি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন ব্যারিস্টার মইনুল৷
ব্যারিস্টার মইনুলের গ্রেফতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাসুদা ভাট্টি ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘একটি টেলিভিশনের লাইভ শো-তে তিনি এই মন্তব্য করেছেন৷আমি তাই প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছিলাম৷ তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ফোন করার পর আমি তাকে এই পরামর্শ দেই৷ কিন্তু তিনি সেটা করেননি৷ ফলে আমি সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছি৷ এখন বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে৷ আদালতই বিষয়টা দেখবে৷ আর বিষয়টা এখন আর আমার একার বিষয় নেই৷ এটা সারাদেশের নারী সমাজের বিষয়৷'' এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি রাজনীতি ঢুকে যায় তাহলে নারীদের সম্মান রক্ষার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা জানতে চাইলে মাসুদা ভাট্টি বলেন, ‘‘কোনোভাবেই ক্ষতিগ্র্স্ত হবে না৷ কারণ, নারীদের এই আন্দোলনে রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন আছে৷ রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনো আন্দোলনই সফল হয় না৷ ফলে আমি এটাকে অন্যভাবে দেখি না৷''
মঙ্গলবার আদালতে শুনানির সময় পুলিশ ও আইনজীবীদের আদালতের ভেতরে প্রবেশ করা নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়৷ তখন আইনজীবীরা হট্টগোল শুরু করলে বিচারক শান্ত হতে বলেন৷ বিচারক বলেন, ‘‘নিরাপত্তার কারণে পুলিশ আদালতে বেশি লোক ঢুকতে দেয়নি৷ আর এখানে তো সিনিয়র আইনজীবীরা আছে৷'' মইনুল হোসেনের জামিনের বিরোধিতা করে আইনজীবী আবু আব্দুল্লাহ শুনানিতে বলেন, ‘‘উনি একজন নারী সাংবাদিককে চরিত্রহীন বলেছেন৷ এটা সবাই সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখেছেন৷ তিনি নারী সমাজকে কলঙ্কিত করেছেন৷'' কাজী নজিবুল্লাহ হিরু জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘মইনুল হোসেন শুধু মাসুদা ভাট্টিকে অপমানিত করেননি, তিনি সারা নারী সমাজকে অপমানিত করেছেন৷ আজকে কিছু কিছু নারী অগ্রসর হচ্ছে, তাঁদেরকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন৷ এরপর ওনাকে বলা হলো, ‘আপনি মাফ চান'৷ উনি বলেছেন, ‘‘আমি পার্সোনালি ফোন করেছি৷'' তিনি পুরো নারীসমাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন৷ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পুরোসমাজ৷''
এর আগে সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রবের বাসা থেকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷
গত ১৬ অক্টোবর বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের একটি টকশো-তে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন ও আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে নারী সাংবাদিক ও সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে মাফ চাইতে বলেন৷ তিনি এরপর দুঃখপ্রকাশ করে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলেও তাকে প্রকাশ্যে মাফ চাওয়ার আহ্বান জানান তাঁরা৷ এরপর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেন মাসুদা ভাট্টি৷ পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরো মামলা দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে৷
নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টের শুরু থেকেই এর সঙ্গে আছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন৷ ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওনার গ্রেফতারের পর আমরা এখনো বসিনি৷ তবে আমার ব্যক্তিগত মত বলতে পারি, সেটা হলো, এটা নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এটা ঠিক৷ এর মধ্যে কোনোই পয়েন্ট নেই, সেটা বলব না৷ তবে বিতর্কটাকে যেভাবে চাউর করা হয়েছে, তাতে এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় অবশ্যই আছে৷ তবে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে মামলা করবেন, আদালত বিচার করবে৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন এটা নিয়ে মামলা করতে বলেন, তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে প্রতিহিংসার বিষয় আছে৷ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দেখানো যাবে না৷ প্রধানমন্ত্রী বললেন এরপর মামলা হলো৷ তারপর রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো৷'' এটা নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট কিছু ভাবছে কিনা জানতে চাইলে জনাব মান্না বলেন, ‘‘আমরা এখনো বসিনি৷ বসলে তখন বলা যাবে কী করছি৷''
এদিকে মঙ্গলবার গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন একটা বিবৃতি দিয়েছেন৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘এ সময় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার অনাকাঙ্খিত৷ আমরা যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গাঠন করেছি, তা প্রধানমন্ত্রীর চিন্তার অনুকূল৷ কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে আমরা উদ্বিগ্ন৷ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনার জন্যই আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গাঠন করেছি৷ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছি৷ বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি-গ্রেফতার অনাকাঙ্খিত৷''
অপরদিকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি রোধেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ মইনুলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে মামলার কারণে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তার সংশ্লিষ্টতা এখানে কোনো বিষয় নয়৷'' আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও এ বিষয়ে কথা বলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার আগে থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে টেলিভিশন টক শো-তে অনেক কথাই বলতেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন৷ কিন্তু তখন তো তাকে গ্রেফতার করা হয়নি৷ বরং সাম্প্রতিক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ এটার সঙ্গে রাজনীতি মেলানোর সুযোগ নেই৷''