নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব ইসি'র জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
৬ নভেম্বর ২০১৮ডয়চে ভেলে: সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ কমিশনের প্রস্তুতি কেমন দেখছেন?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন: এটা তো বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না৷ বলাও তো মুশকিল৷ তবে দুই রকম প্রস্তুতি আছে৷ একটা হলো লজিস্টিক৷ সেটা গত ৪৭ বছর ধরে হয়ে আসছে৷ তাঁরা কিন্তু এটাতে পারদর্শী৷ এই প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই হয়৷ এটা নিয়ে খুব একটা কমপ্লেন কখনো থাকে না৷ সময়মতো বুথ বানানো হয়, সবকিছু ঠিকমতোই পাওয়া যায়৷ একটা সেট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা কাজ করেন৷ কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অপারেশন৷ চ্যালেঞ্জগুলো তারা কীভাবে মোকাবেলা করবে সেই প্রস্তুতিটা এখনো পরিষ্কার না৷ কী কী চ্যালেঞ্জ আছে সেটা আইডেন্টিফাই করেছে কিনা, আইডেন্টিফাই করলে তারা এগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটা এখন দেখার বিষয়৷
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন–এই দুটোর মধ্যে তফাৎ কতটুকু?
দেখুন, এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোতে সরকারি দলই সবসময় ফেরত আসে৷ সরকার যখন থাকে, তখন প্রশাসনের লোকজন আনুগত্য দেখায়, একটা হেল্পলেসনেস শো করে৷ আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিন্তু তাঁরা নিরপেক্ষ থাকেন৷ তখন তাঁরা জানেন না যে, কে ক্ষমতায় আসবে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইলেকশন কমিশন (ইসি) পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে৷
সম্প্রতি বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার পক্ষে প্রস্তাব দিয়েছে৷ আপনার মত কী?
এটা আমাদের একটা প্রপোজাল ছিল৷ আমরা তখন এটাকে অধীনে বলিনি৷ এটা আমরা বলেছিলাম ‘আন্ডার সুপারভিশন'৷ মানে ইলেকশন কমিশন কোনো মন্ত্রণালয় চালানোর ক্ষমতা রাখে না, যেটা হয় সেটা সুপারভিশন৷ মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে ইলেকশন কমিশনের কাছ থেকে একটা ছাড়পত্র নিতে হয় যে, এটা করা যাবে কি যাবে না৷ এটা বাংলাদেশে এখন নতুন শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু এটা এই উপমহাদেশে বহুদিন আগে থেকেই প্র্যাকটিস হয়ে আসছে৷ আমরা যদি ইন্ডিয়ান ইলেকশন কমিশনের দিকে তাকাই, সেখানে কিন্তু কোনো আইন নেই, কিন্তু কাস্টমাইজ অব ল বা কোর্ট যদি কোনো কিছু কগনিজেন্সে নেয়, সেটা কিন্তু মানতে হয়৷ সেখানে গত ইলেকশনের আগে আমরা দেখেছি যে, সেনাপ্রধানের নাম পর্যন্ত ইলেকশন কমিশন ঘোষণা করতে দেয়নি৷ ইলেকশনের আগে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না যা ইলেকশন কমিশন জানে না, এই ধরনের সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়কে প্রভাবিত করে৷
নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের পুলিশ এবং প্রশাসনের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকে বা কতটা সহযোগিতা পায়?
আমরা যদি সাদা চোখে দেখি তাহলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আছে৷ কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালি যে কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটা আপেক্ষিক৷ এখানে ইলেকশন কমিশনকে কিছু কাজ করতে হয়৷ আপনি কী ভাবেন, কীভাবে কন্ট্রোল করবেন, কীভাবে খবরগুলো পাবেন– সেই ব্যবস্থাগুলো আপনাকে এখনই করতে হবে৷ আমাদের সময় আমরা কিন্তু তিনজনই খুবই মনিটর করতাম৷ খবরের কাগজ, টেলিভিশন বা অন্যান্য মাধ্যম থেকে আমরা খবর নিতাম৷ কিছু সোর্সও ছিল৷ আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কারেকশন করার জন্য জোর দিতাম এবং আল্টিমেটাম দিতাম৷ রিটার্নিং অফিসারের পেছনে যে কেউ আছে সেটা তাকে অনুভব করার জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন হতো, আমরা ব্যক্তিগতভাবে সেগুলো করতাম৷ সেটা হয়তো আমাদের স্টাইল ছিল৷ এটা ডিপেন্ড করে যে, ইলেকশন কমিশন কতটা এ্যাফোর্ট করতে চায়৷ শুধু তো অ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷ একজন প্রিজাইডিং অফিসার হেল্পলেস ফিল করছে, তাঁকে তো পেছন থেকে কারো সাহস দিতে হবে৷ তাঁকে বলতে হবে, আপনি এই মুহূর্তে হেল্পলেস ফিল করলে এটা করবেন৷ সেটার জন্য ইনফরমেশন পেতে নির্বাচন কমিশনকে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়৷
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন?
আমি তো বলব হান্ড্রেড পার্সেন্ট৷ মানে ১০০ শতাংশ এবং অনেক দেশ থেকে বেশি স্বাধীন৷ কারণ হচ্ছে যে, এটা স্ট্রাকচারালি স্বাধীন, অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন, ডিসিশন মেকিংয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ কিন্তু স্বাধীনতা হচ্ছে আপেক্ষিক বিষয়৷ আপনি নিজে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে চান৷ এখন ধরেন একটি রাষ্ট্র স্বাধীন৷ আপনি যদি কারো সাথে লাইন করেন, কিছু ছাড় দেন, এটা তো আপনার ইচ্ছা৷
নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রসঙ্গ এসেছে৷ এটা নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে৷ আপনারাই তো প্রথম ইভিএম ব্যবহার করেছিলেন৷ এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আমার মতে, এটা একটা টেকনোলজি৷ এটা অনেকেই বোঝে না৷ অনেক পলিটিক্যাল পার্টি পলিটিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে৷ অনেকে এটা ই-ভোটিংয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলছে৷ কিন্তু ই-ভোটিং আর ইভিএম দুটো আলাদা জিনিস৷ বিষয়টা হলো, আমরা যখন করি, তখন আমরা এরকম বহু প্রেসারের মধ্যে ছিলাম৷ তখন কিন্তু আমরা পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সাথে আলোচনা করেছি৷ তখন সবাই বলল যে, আপনারা ছোট ছোট নির্বাচনে অল্প অল্প করে ব্যবহার শুরু করেন, লোকাল ইলেকশনে এগুলো ব্যবহার করেন যাতে আমরাও দেখি, মানুষও দেখে৷ আমরা কিন্তু তখন লোকাল ইলেকশনে এটা আস্তে আস্তে ব্যবহার করি৷ আমরা তখন ভেবেছিলাম যে, এটা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করার পর পলিটিক্যাল পার্টিও দেখবে, সাধারণ মানুষও দেখবে৷ এভাবে চলতে থাকলে একটা পর্যায়ে এটা ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু আমরা চলে আসার পর দেখেছি এটা আর কন্টিনিউ করা হয়নি৷ এই কারণে এখন আবার নতুন করে শুরু করতে যাওয়ায় এটা নিয়ে কথা হচ্ছে৷ আমার মত হচ্ছে, এটা নিয়ে যেহেতু আপত্তি আছে, তাই সামনের ইলেকশনে এটা তড়িঘড়ি না করে পরবর্তী পর্যায়ে যে লোকাল ইলেকশনগুলো হবে, সেগুলোতে করলে ভালো হয়৷ ভারতে কিন্তু এটা চালু করতে ২৫ বছর লেগে গেছে৷ এটা আমাদের মনে রাখতে হবে৷
আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা দেখেন ?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়নের প্রয়োজন হয়৷ এই কারণে যে ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র, ১০ কোটি মানুষ ভোট দিতে যাবে, সেখানে সিকিউরিটি একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়৷ বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে৷ অনেক দেশ, এমনকি এশিয়ার অনেক দেশেও একজন পুলিশ থাকলেও যথেষ্ট৷ কিন্তু আমাদের তো পরিস্থিতি তেমন না৷ আমাদের এখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের অপ্রতুলতা আছে৷ সেনাবাহিনীকে রাখা হয়, তারা পরিস্থিতি দেখে কাজ করবে৷ এ পর্যন্ত যতগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে সবসময় সেনাবাহিনী ডেকে আনা হয়েছিল, তারা এভাবে কাজ করেছে৷
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে৷ এছাড়া তাদের অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিবেচনা করলে একটা সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে বলে মনে করেন?
যাঁরা আছেন তাঁরাতো সবাই অভিজ্ঞ মানুষ৷ তাঁদের সবারই প্রশাসনে বড় অভিজ্ঞতা আছে৷ অন্যান্য বিষয়েও অভিজ্ঞতা আছে৷ তাঁরা চাইলে তাঁদের তরফ থেকে যেটা করা দরকার, সেটা কিন্তু তাঁরা করতে পারেন৷ আর বাকিটুকু তো তাঁরা একা করেন না, সরকার, পলিটিকাল পার্টি সবার একটা কন্ট্রিবিউশন থাকে৷ কাজেই এরকম কোয়ালিফাইড লোকজন যখন আছেন, তাঁরা যে করতে পারবেন না এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না৷ লোকাল ইলেকশন ভালো হয়নি৷ অবশ্যই তাঁদের কিছু গাফিলতি ছিল৷ অন্যান্য বিষয়েও গাফিলতি ছিল৷ সেটা তাঁদের উতরাতে হবে এবং উতরানোর ক্যাপাসিটি তাঁরা রাখেন এটা আমি বিশ্বাস করি৷ তাঁদের হাতে আইন আছে, তাঁদের লোকবল আছে, সর্বোপরি তাঁদের হাতে সংবিধান আছে৷ ফলে এটা না পারার কোনো কারণ আমি দেখি না৷
বাংলাদেশে একটি দলীয় সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও প্রশ্নাতীত নির্বাচন করতে গেলে কোন কোন জায়গায় সংস্কার বা কাজ করা প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?
এই যে সংসদ সদস্যরা, তাঁরা তো নমিনেশন পাবেন৷ তাঁরা ইলেকশন করবেন৷ তাঁরা গত ১০ বছর ধরে এমপি হিসেবে আছেন৷ এলাকায় কিন্তু তাঁদের একটা ইনফুয়েন্স তৈরি হয়েছে৷ থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে স্কুলের হেডমাস্টার সবার উপরই তাঁদের মোটামুটি একটা প্রভাব রয়েছে৷ আমাদের দেশে এমপিদের কিন্তু ইনফ্লুয়েন্স থাকে৷ এটা কিন্তু একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে৷ এটা নির্বাচন কমিশন কীভাবে দেখবে? পাশাপাশি মন্ত্রী মহোদয় যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি নির্বাচন করতে যান, সেখানে আরো বেশি কমপ্লিকেশন তৈরি হবে৷ এইসব কিন্তু এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ এখন যা দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কিন্তু সরকারের লাইনে কথা বলেন৷ কিন্তু নির্বাচন যখন হবে, তখন এই কর্মকর্তারা কি রাতারাতি উল্টে যাবেন? বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি তা বলে? কাজেই এই জিনিসগুলো একটা বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটা নির্বাচন কমিশনকে দেখতে হবে৷ আর সরকারের যদি টোটালি আন্তরিক ইচ্ছা না থাকে, তাহলে ইলেকশন কমিশন ইমপ্লিমেন্ট করলেও তা ফেল করবে৷