1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে র‍্যাবের দিনকাল

DW Mitarbeiterportrait | Tanjir Mohammad Mehedi Chowdhury
তানজীর মেহেদী
৪ নভেম্বর ২০২২

দেড় যুগ আগের কথা৷ ২০০৪ সালে জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবসের প্যারেডে অংশ নেয়ার মাধ্যমে দেশের মানুষের সামনে হাজির হয় র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)৷

https://p.dw.com/p/4J4fl
Bangladesch Dhaka - Rapid Action Batallion (RAB)
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath

দেশের উন্নতির পথে ‘অস্থিতিশীল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে' অন্যতম বাধা আখ্যা দিয়ে পুলিশের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে ‘এলিট ফোর্স' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় র‍্যাব৷ ওই বছরের ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পায় বাহিনীটি৷ এর মধ্য দিয়ে অপারেশনাল কাজ শুরু করে তারা৷

১৮ বছরের পথ চলায় কলেজ পড়ুয়া লিমনের পায়ে গুলি করা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর এলিট ফোর্সটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর৷

ওইদিন ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার' অভিযোগ এনে র‍্যাব এবং সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনকে ইঙ্গিত করেছে দেশটি৷

যদিও অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে বাংলাদেশ৷ বরং সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই৷ কিন্তু তারপরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ধাক্কা খেয়েছে বাহিনীটি৷

গত ৬ অক্টোবর গণভবনে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও র‍্যাব প্রসঙ্গে কথা বলেন সরকারপ্রধান৷

সেদিন তিনি বলেছেন, ‘র‍্যাবের ওপরে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যখন স্যাংশন দিল, আমার প্রশ্নটা হচ্ছে র‍্যাব সৃষ্টি করেছে কে? র‍্যাব সৃষ্টি তো আমেরিকার পরামর্শ৷ আমেরিকা র‍্যাব সৃষ্টি করার পরামর্শ দিয়েছে৷ আমেরিকা তাদের ট্রেনিং দেয়৷ তাদের অস্ত্রশস্ত্র, তাদের হেলিকপ্টার, এমনকি তাদের ডিজিটাল সিস্টেম, আইসিটি সিস্টেম-সবই আমেরিকার দেয়া৷'

বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনে র‍্যাব বিশেষ ভূমিকা রাখায় যুক্তরাষ্ট্র ‘নাখোশ' হয়েছে কিনা, সেদিন সে প্রশ্নও তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷

নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বাহিনীর সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দাবি করেছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে একেবারেই বাধ্য না হলে র‍্যাব সদস্যরা কখনও গুলি ছোড়েন না৷

২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে বিদায়ী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘র‍্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেখানে যেটুকু প্রয়োজন পড়ে, আইন মেনে সেটুকু শক্তি প্রয়োগ করে৷ আমরা যখন আক্রান্ত হই, তখনই আমাদের পাল্টা জবাব দিতে হয়৷

‘সিচ্যুয়েশন যেমন ডিমান্ড করে, আমরা ঠিক তেমন ব্যবস্থা নিয়ে থাকি৷ এমন কখনও হয় না যে, কেউ আমাদের ধাক্কা দিল আর আমরা গুলি করে দিলাম৷ র‍্যাবের প্রত্যেক সদস্যকে এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ এলিট ফোর্স হিসেবে আমাদের সবসময় চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়৷'

র‌্যাব মহাপরিচালকের এমন বক্তব্য কিংবা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অবস্থানে এখনও অনড়৷ ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন, র‍্যাবের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হলে মানবাধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে৷

এ দুটো বিষয় নিশ্চিত হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করা যাবে বলে গত ৩১ মে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন তিনি৷

মাসখানেকের কিছু বেশি হলো নতুন মহাপরিচালক পেয়েছে র‍্যাব৷ এখন এলিট ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা এম খুরশীদ হোসেন৷

নতুন মহাপরিচালক অবশ্য পিটার হাসের সংস্কার প্রস্তাব একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন৷ দায়িত্ব নিয়ে ১ অক্টোবর ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয় তাকে৷

জবাবে র‍্যাব মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে র‍্যাব সংস্কারের কোনো প্রশ্নই দেখি না৷ কারণ আমরা এমন কোনো কাজ করছি না যার জন্য র‍্যাবকে সংস্কার করতে হবে৷ আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত যে বিধি আছে, সেই বিধিবিধান অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি৷ আমরা আইনের বাইরে কোনো কাজ করি না৷ সে ক্ষেত্রে সংস্কারের তো প্রশ্নই ওঠে না৷'

পরের দিনই উল্টো বক্তব্য দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল৷ তিনি বলেছেন, র‍্যাব সব সময়ই সংস্কারের মধ্যেই আছে৷ তিনি বলেন, ‘আমাদের জানতে হবে তারা অন্যায়টা কী করেছে৷ আর সংস্কারের কথা বলতে, র‍্যাব তো সব সময় সংস্কারের মধ্যেই আছে৷ আমরা সব কিছু আধুনিকায়ন করছি৷ যেটা প্রয়োজন সেটাই দিচ্ছি৷'

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো অবশ্য কিছুটা স্বস্তির খবরই দিচ্ছে৷ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার জন ব্যক্তির গুম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ যাদের মধ্যে একজন ফিরে এসেছেন৷ অপরজনের কথা জানিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী৷ এখনও নিখোঁজ দুই জন৷

তবে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বছরের প্রথম ৯ মাসে ১৫টি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র৷ ১৫টি ঘটনার মধ্যে পাঁচটির দায় দিয়েছে এলিট ফোর্স র‍্যাবকে৷ তাদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী গ্রেপ্তারের আগেই র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ার'-এ নিহতের সংখ্যা তিন৷

র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে বলে মনে করেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস৷ তিনি বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা কোনো শাস্তি নয়, বাহিনীটিকে শুদ্ধ করার সুযোগ৷ ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি৷

গত ৩১ অক্টোবর র‍্যাব-৯-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সিলেটে গিয়ে র‍্যাব প্রধান এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল, আমরা তার তদন্ত করেছি৷ সব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি৷ ইতোমধ্যে সবগুলো অভিযোগের জবাব দেয়া হয়েছে৷'

নতুন মহাপরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর র‍্যাবকে আবারও বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে৷ সম্প্রতি পাহাড়েও জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নেমেছে সংগঠনটি৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীটি চায়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের কাছে যাতে র‍্যাব হয় একটি আতঙ্কের নাম৷

দীর্ঘ ১৮/১৯ বছর ধরে পালিয়ে থাকা আসামিদের আইনের কাছে সোপর্দ করার ক্ষেত্রেও সম্প্রতি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে র‍্যাব৷ এর মধ্যে আছে কক্সবাজারে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে ১৮ বছর আত্মগোপনে থাকা আব্দু মুনাফ নামের এক ব্যক্তি৷

Tanjir Mohammad Mehedi Chowdhury DW Praktikant aus Bangladesch
তানজীর মেহেদী, সাংবাদিকছবি: Privat

ময়মনসিংহে বিশ্বজিৎ কুণ্ডু হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া পলাতক আসামি সুমন ওরফে পেটকাটা সুমনকে সাত বছর পর গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব৷

ফেনীর সোনাগাজীতে মাকে বেঁধে অস্ত্রের মুখে ১৩ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি লাতু মিয়া দীর্ঘ ১৯ বছর পলাতক থাকার পর সম্প্রতি ধরা পড়েছে র‍্যাব হাতে৷

বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মোশাররফ হোসেনকে প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ নেত্রকোণার সদরে যুবক হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া পলাতক আসামিকে ১৭ বছর পর গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব৷

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে অবদান রাখার পাশাপাশি সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত ঘোষণার ক্ষেত্রেও র‍্যাব অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে৷ মাদক নির্মূলে র‍্যাবের অনেক সাফল্য থাকলেও কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনাও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাদের৷ মৃত্যুর আগ মুহূর্তে পিতার সঙ্গে শিশুকন্যার সেই আকুলতা, ‘আব্বু, তুমি কানতেছ যে...?'-সহজে মুছে যাবে না মানুষের মন থেকে৷

যদিও র‍্যাবের দাবি, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দায়িত্বটি সরকারের৷ তারা তাদের নীতিতে অবিচল থেকে কাজ করে যাবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে৷

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন নিষেধাজ্ঞা দৃশ্যত না হলেও একটি বাহিনীকে নাজুক করে দিতে পারে৷ যদিও মাঠের রাজনীতিতে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি পুরো দায় দিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাঁধেই৷

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কখনও জনগণের অধিকার হরণ নয়, বরং তাদের সুরক্ষায় কাজ করবে, অপরাধীকে দাঁড় করাবে আইনের কাঠগড়ায়৷ র‍্যাব তার ভাবমূর্তি কতোটা ফিরিয়ে আনতে পারবে সেটা নির্ভর করবে তাদেরই কর্মকাণ্ডে৷