মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চার মাস পর প্রথম ‘ক্রসফায়ার'
১৮ এপ্রিল ২০২২গত শনিবার রাতে কুমিল্লার সদর আদর্শ উপজেলার গোলাবাড়ি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' রাজু নামে একজন নিহত হন৷ তিনি সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম হত্যার আসামি৷
কুমিল্লার সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারকে গত ১৩ এপ্রিল(বুধবার) রাত ১০টার দিকে ডেকে নিয়ে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত এলাকায় দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে৷ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১৪ এপ্রিল( বৃহস্পতিবার) রাতে এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে৷ আরেকজন এজাহারভুক্ত আসামি রাজু র্যাবের সঙ্গে শনিবার রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন৷ রাত দুইটার দিকে ওই ঘটনা ঘটে৷
র্যাব ১১-এর কুমিল্লা ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান, ‘‘আমরা সাংবাদিক হত্যার আসামি ধরতে কোনো অভিযান চালাইনি৷ সে রাজু কি না তাও আমরা জানতাম না৷ আমাদের কাছে খবর ছিলো গোলাবাড়ি এলাকায় একদল সন্ত্রাসী নাশকতা করার জন্য আত্মগোপন করে আছে৷ এই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের টহল টিম সেখানে পৌঁছালে তারা আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে৷ আমরাও আত্মরক্ষার্থে গুলি করি৷ গোলাগুলি শেষ হলে আমাদের এক সদস্যকে আহত দেখতে পাই৷ চার-পাঁচজন লোক পালিয়ে যায়৷ এলাকার লোকজন এসে পড়ে৷ আমাদের সদস্যকে উদ্ধার করার পর আশপাশে খোঁজাখুঁজি করে দেখি গুলিতে আহত একজন অজ্ঞাত যুবক পড়ে আছে৷ তার পাশে একটি লোডেড পিস্তল৷ তাকে উদ্ধার করে আমরা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই৷ আমরা জীবিত অবস্থায়ই হাসপাতালে পাঠাই তাকে৷''
তিনি বলেন, ‘‘পিস্তল ছাড়াও তার কাছে কয়েকটি ইয়াবা, দেড় বোতল ফেনসিডিল এগুলো পাওয়া যায়৷ মাদক বলতে যা বুঝায় সেরকম কিছু না৷ আমাদের কাছে সেরকম তথ্যও ছিলো না৷ আমরা জানতাম অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ওইখানে আছে৷''
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. দুলাল বলেন, ‘‘হাসপাতালে আনার পর পরই তাকে ডেড ডিক্লেয়ার করা হয়৷ হাসপাতালের খাতায় তাই লেখা আছে৷''
গত ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এই প্রথম বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল৷ তবে ওই নিষেধাজ্ঞার কয়েক ঘণ্টা আগেও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ ১০ সিসেম্বরের আগের পাঁচদিনে ক্রসফায়ারে পাঁচজন নিহত হয়েছে৷
এর আগেও ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের হাতে ক্রসফায়ারের নামে মেজর(অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ ছিলো৷
আর ২০১৮ সালের ২৬ মে কক্সবাজারের টেকনাফের ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হককে বন্দুক যুদ্ধের নামে হত্যার ঘটনার পর একটি অডিও প্রকাশ হওয়ায় ক্রসফায়ার নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ তখনো কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ ছিলো৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮০টি৷ ২০২০ সালে ২২২ জন এবং ২০১৯ সালে ৩৮৮ জন নিহত হন৷ তাদের হিসবে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷
আসকের তথ্যমতে শনিবারের ক্রসফায়ারের ঘটনার আগে চলতি বছরে বাংলাদেশে আর কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি৷ তবে পুলিশ ও র্যাব হেফাজতে চারজন মারা গেছেন৷
আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা অতীতেও দেখেছি কোন চাপ বা মানুষের ক্ষোভের পর কিছুদিন ক্রসফায়ার বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়৷ এবারও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর আমরা সেই আশঙ্কা করেছিলাম৷ শনিবারের ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণ হলো৷
‘‘রাষ্ট্র ও সরকার যতদিন পর্যন্ত এইসব ঘটনার স্বাধীন তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় না আনবে ততদিন এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না৷ রাষ্ট্র যদি এটাকে কৌশল হিসেব নেয় তাহলে তো বন্ধ হবে না৷''
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘যতদিন পর্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম যতদিন পর্যন্ত উন্নত করা না যাবে, এই কলোনিয়াল পুলিশ কোর্ট ও প্রসিকিউশন যত দিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই অবস্থার উন্নতি হবে না৷ এ জাতীয় বিষয়ের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘কে নিষেধাজ্ঞা দিলো৷ তার দেশের অবস্থা কী সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের স্বার্থেই এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে৷ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷''