নিয়োগের দাবিতে হবু শিক্ষকদের অনশন
৩ মার্চ ২০২২পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পর্যায়ে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাদ দিয়ে অসাধু উপায়ে নিয়োগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে বলে দাবি করছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
দুর্নীতির অভিযোগ
পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত ২০১৬ সালের স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্ট (এসএলএসটি) নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলকারীদের দাবি, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হচ্ছে। কখনো বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হচ্ছে। অভিযোগ, অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যরা তো বটেই, রাজনৈতিক নেতার মেয়েও চাকরি পেয়েছেন। এমনকী পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের নিয়োগ করা হয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে সুখেন সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ রকম অসংখ্য অভিযোগ আছে। আর প্রত্যেকটার আরটিআই কপি আমাদের কাছে আছে। যাদের প্যানেলে নাম ছিল না কিংবা যারা পরীক্ষাই দেয়নি, এমন অনেকে নিয়োগ পেয়েছেন।" মেধা তালিকায় থাকা চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, গেজেট অনুযায়ী নম্বর-সহ পূর্ণাঙ্গ মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকী ১:১.৪ অনুপাত বজায় রেখে ইন্টারভিউ ডাকা হয়নি। অর্থাৎ ১০০ জনকে চাকরি দিলে ইন্টারভিউয়ে ডাকার কথা ছিল ১৪০ জনকে। এই পদ্ধতি অনুসরণ না করে চুপিসারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
পলাশ-নাসেরদের যন্ত্রণা
কৃষ্ণনগরের অভাবী পরিবারের তরুণ আবু নাসের ইতিহাসের কৃতী ছাত্র। এসএসসি-র মেধা তালিকায় নাম থাকার পরেও তার নিয়োগ হয়নি। নবম-দশম স্তরের শিক্ষক পদপ্রার্থী হয়েই রয়ে গেলেন। শুধু নাসের নন, এ ভাবেই স্বপ্ন খানখান হয়ে যাচ্ছে রেহেসান আলি, পলাশ মণ্ডল বা সুখেন সরকারের। শুধু কি স্বপ্নভঙ্গ, একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকছেন আন্দোলনকারীরা। নবম-দশম স্তরের চাকরিপ্রার্থী মিলন মালের কাছেও নিয়োগ হয়ে উঠেছে মরীচিকা। চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীদের দাবি, প্রবল মানসিক চাপে স্ট্রোক হয় হুগলির বাসিন্দা মিলনের। এখন তিনি শয্যাশায়ী। মালদহের মিঠু মণ্ডল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর থেকেও মর্মান্তিক পরিণতি আছে। বাবু দোলুই, অতনু মিস্ত্রি আত্মহত্যা করেছেন সম্প্রতি। আন্দোলনকারীরা এ সব ঘটনাকে নিয়োগে অনিয়মের পরিণতি হিসেবে দেখছেন।
আন্দোলনে অনড়
২০১৯ সালে কমিশনের বিরুদ্ধে প্রেস ক্লাবের সামনে হবু শিক্ষকেরা ২৯ দিন ধরনা ও অনশন আন্দোলন শুরু করেন। আবু নাসের জানান, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এসে মেধা তালিকায় থাকা সব প্রার্থীকে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর ফের দ্বিতীয় বার আন্দোলন করতে হয় চাকরিপ্রার্থীদের। সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের ৫ নম্বর গেটে ধরনা অবস্থান ও অনশন শুরু করেন তারা। ১৮৭ দিন এই দফার কর্মসূচি চলে। ২০২১ সালের ১০ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান চাকরিপ্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। সময় পার হলেও কথা রাখা হয়নি বলে অভিযোগ। তাই ফের এ বার তৃতীয় দফায়, ধর্মতলা চত্বরে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ধরনা অবস্থান শুরু করেছেন তারা। ফুটপাতে শুয়ে শুরু করেছেন অনশন।
প্রতিকার হবে কবে?
প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা। অনশনের ২৩তম দিনে চাকরিপ্র্রার্খী অভিষেক সেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তিন দফা মিলিয়ে প্রায় ৩৫০ দিন আমাদের আন্দোলন চলছে। সেই ২০১৯ সাল থেকে যারা মেধা তালিকায় ঠাঁই পেয়েছি, তাদের নিয়োগ কিন্তু এখনও হয়নি। আমরা চাই সত্যটা উদঘাটিত হোক। সিবিআই বা সিআইডি যে কোনও তদন্ত হোক না কেন, আমাদের নিয়োগ স্বচ্ছভাবে হোক।” পদ্মশ্রী-তে সম্মানিত শিক্ষাবিদ কাজি মাসুম আখতার ধরনা মঞ্চে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, "আমি ওদের নথিপত্র খতিয়ে দেখে বুঝেছি যে দাবি যথার্থ। গত সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে আর্জি জানিয়েছি, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলা হোক। সরকার চুপ করে বসে না থেকে পদক্ষেপ করুক।”
ভরসা যখন আদালত
কলকাতা হাইকোর্টে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একগুচ্ছ মামলা চলছে। সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। পরে সেই নির্দেশে উচ্চতর বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন জানাতে পারেন চাকরিপ্রার্থীরা। তবে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায়ে আশার আলো দেখছেন আন্দোলনকারীরা। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে গ্রুপ ডি-তে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫৭৩ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তারা যে বেতন পেয়েছেন, সেটাও ফেরাতে বলেছেন বিচারপতি। আন্দোলনকারীদের আশা, সরকার যদি প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে, তা হলে আদালতের রায়ে তারা সুবিচার পাবেন।