নয়া হাসপাতাল বিল পশ্চিমবঙ্গে
৩ মার্চ ২০১৭শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেই পেশ করলেন ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্টস্ (রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি) বিল, ২০১৭'৷ এই বিলে চিকিৎসার গাফিলতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হলো৷ এক নজরে নিয়মগুলি যা দাঁড়ালো— চরম গাফিলতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম জরিমানা ১০ লক্ষ টাকা৷ বড় ক্ষতির ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ এবং তুলনায় কম ক্ষতির ক্ষেত্রে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা৷ এই ক্ষতিপূরণ বিপত্তি ঘটার এক মাসের মধ্যে আংশিক এবং ছয় মাসের মধ্যে পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে হবে৷ এছাড়া বলা হলো, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতি না দেখে, সবার আগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ অ্যাসিড হামলা এবং ধর্ষণের শিকার হবেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম৷ বলা হয়েছে, এমার্জেন্সি বিভাগ থেকে রোগী প্রত্যাখ্যান করা যাবে না৷ বিল মেটাতে না পারলে মৃতদেহ আটকে রাখাও যাবে না৷ নতুন বিলে খুব স্পষ্ট করে দেওয়া আছে যে, যে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এইসব নিয়ম মানবে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে৷ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে বিলে৷
দু'ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে এই নতুন নিয়মের৷ এক, রাজনৈতিক, দুই, পেশাদারি৷ বিরোধী রাজনৈতিক শিবির বলছে, লোক দেখিয়ে এই নতুন বিল আনার কোনো দরকার ছিল না৷ কারণ, ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার এই একই বিল বিধানসভায় পাস করায়, যার সাহায্যে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা হয়েছিল৷ চরিত্র বা উদ্দেশ্যগতভাবে দুটি বিলের কোনো ফারাক নেই, কিছু গঠন ও প্রয়োগগত খুঁটিনাটিছাড়া৷
যেমন নতুন বিলে বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা, মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কমিশন গড়ার কথা৷ আগের বিলে কমিশনের জায়গায় সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিশেষ ট্রাইবুনালকে৷ আগের বিলে বলা হয়েছিল, এমার্জেন্সিতে আনা রোগীর চিকিৎসা করা বাধ্যতামূলক৷ এই বিলেই সেটাই বলা হয়েছে৷ আগের বিলে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, নতুন বিলে সেই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়িয়ে ১০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে৷ অকারণে অতিরিক্ত টেস্ট করালে, অত্যাধিক ফি নিলে জরিমানা, এমনকি লাইসেন্স বাতিলের নিদানও আগের বিলেই দেওয়া হয়েছিল৷ বস্তুত সেই আইনের জোরেই গত ১০ দিনে রাজ্যে ২৭টি বেসরকারি নার্সিং হোম ও হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে৷ যদিও সেই ২০১০ সালে, তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস আইনটির বিরোধিতা করেছিল৷ বিধানসভার সিলেক্ট কমিটির কাছে ‘নোট অফ ডিসেন্ট' দিয়ে, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনের দাবি করেছিল৷
আর চিকিৎসকরা পেশাগত জায়গা থেকে এই নতুন নিয়ন্ত্রণ বিধিতে আপত্তি জানাচ্ছেন৷ তাঁদেরও বক্তব্য, পুরনো আইনে দোষী বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ গত ৭ বছর ধরেই ছিল৷ কিন্তু সমাজের বাকি সব ক্ষেত্রের মতো এই চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সরকারি নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই রাজ্যে অবৈধ কিডনি কেনা-বেচা, বা শিশু পাচার চক্রের বাড়বাড়ন্ত অবাধে হয়েছে৷ চিকিৎসা করাতে এসে যে কোনো রোগীর মৃত্যুই দুঃখজনক৷ কিন্তু হাসপাতালে রোগী-মৃত্যুর পর হাঙ্গামা, ভাংচুরের ঘটনার পর সরকার যেভাবে কেবল বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকেই একতরফাভাবে দোষী সাব্যস্ত করলেন, তা একেবারেই সঠিক সঙ্কেত দিল না জনগণের কাছে৷ এরপর চিকিৎসকরাও সতর্ক হয়ে যাবেন৷ তাঁরা কেউ ঝুঁকি নেবেন না, দায়িত্ব নেবেন না, উল্টে নিজেদের আইনি সুরক্ষা আরো আঁটোসাঁটো করতে তৎপর হয়ে উঠবেন৷ তাতে চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো চিকিৎসা আদতে হবে না৷
আর সোশাল মিডিয়াতেও অনেকে একটা প্রশ্ন তুলছেন৷ সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার যে বেহাল দশা, তার দায়িত্ব কে নেবেন? কেন লোকে সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভিড় করছে, সেই প্রশ্নের উত্তরই বা কার কাছে আছে?