পণ্ডিত রবি শঙ্করের প্রয়াণ
১২ ডিসেম্বর ২০১২রবীন্দ্র শঙ্করের জন্ম ১৯২০ সালে, বারাণসীতে, এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে৷ চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট৷ বাবা এক বিশ্ব-ভবঘুরে, উকিল, দার্শনিক, লেখক৷ আট বছর বয়স হবার আগে রবি শঙ্কর তাঁকে চাক্ষুষ দেখেনইনি! মা-ই কষ্টেসৃষ্টে মানুষ করেছেন রবি শঙ্করকে৷
১৯৩০ সালে বড় ভাই উদয় শঙ্কর তাঁর নাচের দলের সঙ্গে গোটা পরিবারটিকে উঠিয়ে নিয়ে যান প্যারিসে৷ প্রায় আট বছর রবি শঙ্কর ছিলেন দাদার নাচের দলের সঙ্গে যুক্ত: উদয় শঙ্করের গোষ্ঠী তখন দেশ-বিদেশে সাড়া ফেলেছে৷ সেতারে রবি শঙ্করের বাজনশৈলীর একটি বিশেষত্ব ছিল: তাঁর সেতার শুধু গাইতো না, যেন নাচতোও৷ ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে সিন্ধু ভৈরবী কি শ্রী গোত্রীয় রাগে গোড়ার দিকের কোনো যুগলবন্দি শুনলেই তা আজও স্পষ্ট হয়ে উঠবে৷ কে জানে, দাদার নাচের দল থেকেই হয়ত রবি শঙ্করের এই তাল-লয়ের প্রতি নটসুলভ অনুরাগ এসেছে!
আলী আকবরের পিতা, স্বনামধন্য ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের শিষ্য ছিলেন রবি শঙ্কর৷ সেই সূত্রেই গুরুকন্যা অন্নপূর্ণার সঙ্গে প্রথম বিবাহ৷ এভাবে ভারতীয় মার্গ সংগীতের খানদান থেকে বিটলস গোষ্ঠীর জর্জ হ্যারিসন অবধি বিস্তার এবং বিচরণ ছিল রবি শঙ্করের৷ হিপ্পি আমলে ‘রাভি শাংকার' – এ যখন ব্যাপক উন্মাদনা, তখন একটি কনসার্টে রবি শঙ্কর খরজের তারগুলো মেলানোর পর উপস্থিত মার্কিন জনতা করতালি দিয়ে ওঠে৷ রবি শঙ্কর মাইক টেনে নিয়ে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের বললেন, ‘তার মেলানোই যদি এত ভালো লাগে, তবে বাজনাটা নিশ্চয় আরো ভালো লাগবে৷' একেই বলে রসবোধ৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময় বিদেশি বন্ধুদের নিয়েই রবি শঙ্কর নেমে পড়েছিলেন মুক্তিযু্দ্ধের পক্ষে প্রচার এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে৷ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'৷ বিশ্ব সংগীতের বিখ্যাত এই দুই বন্ধু ছাড়াও সেখানে অংশ নিয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, জোয়ান বায়েজ, আলী আকবর খানের মতো শিল্পীরা৷ তাই বাংলাদেশ চিরকাল মনে রাখবে তাঁকে৷
রবি শঙ্করের এক মেয়ে নোরা জোন্স, অন্যজন অনুশকা৷ একজন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নামকরা জ্যাজ গায়িকা, অন্যজন বাবার মতোই সেতার বাজান৷ গত নভেম্বরে মেয়ে অনুশকার সঙ্গে শেষবার স্টেজে বসেন রবি শঙ্কর৷ প্রচারপত্রে লেখা ছিল – শিল্পীর শিল্পসাধনার দশম দশকের সূচনা উদযাপনে এই কনসার্ট!
সত্যাজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি', রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী'-র মতো ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন৷ ইয়েহুদ মেনুহিনের মতো বেহালাবাদকের সঙ্গে যুগলবন্দি বাজিয়েছেন – ভারতীয় রাগে৷ জঁ পিয়ের রামপালের মতো পশ্চিমি বাঁশি-বাদকের জন্য সুর করেছেন, লিখেছেন শাকুকাচি এবং কোতো-র মতো জাপানি সুরযন্ত্রের জন্য সংগীত৷ সেই সঙ্গে আছে এবং থাকবে রবি শঙ্করের স্বরচিত, স্বসৃষ্ট ৩১টি রাগ৷
রবি শঙ্কর চলে গেলেন৷ যেন বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় মার্গ সংগীতের ধারাটিকে একবিংশ শতাব্দীর জন্য সযত্নে সাজিয়ে-গুছিয়ে, নোঙর তুলে, পাল উঠিয়ে দিয়ে গেলেন৷ যেন এক্ষুনি আবার আলি আকবর খানের সঙ্গে যুগলবন্দিতে বসবেন, যেমন শুনেছি কোন কালে কলকাতার আশুতোষ কলেজের কোনো কনসার্টে: স্টেজের ওপর বসে ছিলেন নাকি আলাউদ্দীন খান স্বয়ং, খেয়াল রাখছিলেন, আগামীকালের দিকপাল তরুণ শিল্পীরা বেচাল কিছু যেন বাজিয়ে না ফেলে...
এসি/এসিবি (রয়টার্স, এএফপি, পিটিআই)