পর্যটন উন্নয়নের বিকল্প?
২৭ আগস্ট ২০১৩মিশরে লোহিত সাগরের তীরে সৈকতাবাসগুলোতে টুরিস্টদের ভিড় নেই৷ কাজেই বহু হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা তাঁদের কর্মীদের বিনা বেতনের ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন৷ অথচ ২০১১ সালের বিপ্লবের পর মিশরের পর্যটন শিল্প সবে নিরাময়ের পথে যাচ্ছিল: ২০১২ সালে এক কোটি ১৫ লাখ পর্যটক মিশরে আসেন, অর্থাৎ ২০১১-র তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি৷
জাতিসংঘের বিশ্ব টুরিজম সংগঠন ডাব্লিউটিও-র মুখপাত্র সান্ড্রা কারভাও ডয়চে ভেলের সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন: ‘‘টুরিজম হলো বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে নিশ্চিত শিল্পগুলির মধ্যে একটি৷ টুরিজমের উপর প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা সংঘাতের অব্যবহিত প্রভাব পড়ে বটে, কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পর্যটন শিল্প আবার সু্স্থির হয়, এমনকি সংকটের আগে যা ছিল, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে৷''
‘পর্যটন হলো উন্নয়নের মোটর'
ইউএনডাব্লিউটিও-র মোদ্দা কথা হলো, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলিতে পর্যটন হলো উন্নয়নের মোটর বিশেষ৷ পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিবিধির নয় শতাংশ আসে পর্যটন থেকে; বিশ্বের প্রত্যেক পঞ্চম চাকুরিস্থান এই পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল – মিশরের ক্ষেত্রে মোট চাকুরির ১৩ শতাংশ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভর৷
কারা এই পোষ্য? হোটেলের মালিক ও কর্মীরা, ট্যাক্সিচালক, সুভেনির বিক্রেতা; সেই সঙ্গে পূর্ত শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারী-কারিগরেরা; কার্পেট তৈরির মানুষজন; কৃষিজীবী ও অন্যান্যরা যারা হোটেল-রেস্তোরাঁগুলিকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেন; এমনকি হোটেলের জামাকাপড় ধোয়া কিংবা মেরামতের কাজ যাঁরা করেন, সকলেরই রুজি নির্ভর ঐ টুরিস্টদের উপর৷
পরিসংখ্যান এক কথা৷ কিন্তু এ সব কাজের ধরন অথবা পারিশ্রমিকের কম-বেশি সম্পর্কে পরিসংখ্যান থেকে বিশেষ কিছু জানা যায় না৷ জার্মানির প্রটেস্টান্ট গির্জার ‘ব্রোট ফ্যুর দি ওয়েল্ট' উন্নয়ন সেবার আন্টিয়ে মন্সহাউজেনের সেখানেই আপত্তি৷ ‘‘(এগুলো হলো) কম যোগ্যতার, মরশুমের চাকরি৷ যেগুলোয় পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন আন্টিয়ে৷
প্রমোদকাননে দারিদ্র্য
‘‘টুরিস্টদের পক্ষে আকর্ষণীয় বহু উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে৷ যা থেকে প্রমাণ হয় যে, টুরিজমকে নিঃশর্তভাবে উন্নয়নের মোটর হিসেবে গণ্য করা চলে না৷'' মিশরের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের জীবন কাটে জাতীয় দারিদ্র্যসীমার নীচে৷ কেনিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল পথ হলো পর্যটন, দেশের জিএনপি-র ১১ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে৷ কিন্তু এখানেও দেশের জনগণের অর্ধেককে দিনে দু'ডলারের কম আয়ে জীবনধারণ করতে হয়৷
অপরদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যও উন্নয়নের প্রয়োজন: স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো ও পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদের টেঁকসই ও সংবেদনশীল ব্যবহার – এসবই তার অঙ্গ৷ ‘‘গুড গভরন্যান্স'' বা সুশাসন এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগণকে সংশ্লিষ্ট করা ছাড়া টুরিজম লব্ধ অর্থে সাধারণভাবে সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়৷
বাস্তব ও নীতিমালা
কিন্তু বাস্তবে যা ঘটে থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক তার উল্টো৷ ইয়ট প্রমোদতরীর নোঙর ফেলার বন্দর তৈরির জন্য জেলেদের মাছ-ধরা নৌকা নির্বাসিত হয়৷ পশুপক্ষির জন্য অভয়ারণ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের সময় স্থানীয় জনগণকে বিতাড়ন কিংবা পুনর্বাসিত করা হয়৷ এছাড়া বিমানবন্দর কিংবা হোটেল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ কিংবা বেদখল-জবরদখল তো আছেই৷ পর্যটনের উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে এ সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন আন্টিয়ে মন্সহাউজেন৷
বিষয়টি ডাব্লিউটিও-র কাছেও গুরুত্বপূর্ণ৷ ১৫৫টি দেশ আজ বিশ্ব পর্যটন সংগঠনের সদস্য৷ ১৯৯৯ সালেই ডাব্লিউটিও একটি টুরিজম সংক্রান্ত কোড অফ এথিক্স বা নীতিমালা গ্রহণ করে৷ কিন্তু সেই দশ-দফা নীতিমালা কোনোকালেই বিশেষ কার্যকরি হতে পারেনি৷ তার মূল কারণ: নীতিমালা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ, কিংবা লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের অথবা বিচার করার কোনো সুযোগ সংগঠনের নেই৷
আফ্রিকার সুবিখ্যা ভিক্টোরিয়া ফল্স জলপ্রপাতের কাছে বসেছে ডাব্লিউটিও-র এ বছরের বাৎসরিক সম্মেলন৷ চলবে ২৯শে আগস্ট অবধি৷ তবে সম্মেলনে এতটা কণ্টকিত একটি সমস্যার কোনো চটজলদি সমাধানের আশা কম৷