পশ্চিমবঙ্গ: প্রাথমিকের উত্তরপত্র উদ্ধারে প্রয়োজনে হ্যাকার
৭ জুলাই ২০২৪২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। তদন্তে উঠে এসেছে, ওএমআরে ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে, অযোগ্য প্রার্থীদের সুযোগ করে দিতে। এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
হাইকোর্টের নির্দেশ
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআই ওএমআর সংক্রান্ত রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে সন্তুষ্ট হয়নি হাইকোর্ট। শুক্রবার বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা এই রিপোর্টের ভিত্তিতে শুনানি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাননি। আরো নির্দিষ্ট ও জোরালো তথ্য চেয়ে তিনি সিবিআইকে জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।
ওএমআর ও সার্ভার দুর্নীতির 'শেষ দেখতে' সিবিআইকে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বিচারপতির মন্তব্য, "পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারবে সিবিআই। ওএমআরের মূল তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা উদ্ধার করা জরুরি।"
উত্তরপত্র বা ওএমআরের অনিয়মে নিয়োগ দুর্নীতির মূল রহস্য আছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু এই সম্পর্কিত যে তথ্য সিবিআই জোগাড় করেছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করছে আদালত। সেই কারণে বিচারপতি সিবিআইকে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সাহায্য নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
তার বক্তব্য, আইবিএম, উইপ্রো, টিসিএস বা যে কোনো বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সাহায্য নিক সিবিআই। সরকারি কোনো সংস্থা, এমনকী এথিক্যাল হ্যাকারের সাহায্য নিতে পারে কেন্দ্রীয় সংস্থা। হ্যাকার ভিন দেশের হলেও অসুবিধা নেই। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে।
প্রকৃত ও ডিজিটাল তথ্য
২০১৪ সালের পরীক্ষার ভিত্তিতে যে নিয়োগ হয়, তার অস্বচ্ছতার নেপথ্যে ওএমআরে গরমিল মূল কারণ বলে দাবি সিবিআইয়ের। সেই ওএমআর খতিয়ে দেখার সুযোগ আর নেই। আসল ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে বলে হাইকোর্টে আগেই জানিয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ। তারা জানায়, আসল শিট নষ্ট করা হলেও পরিবর্তে তার ডিজিটাল নথি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ওএমআর স্ক্যান করে হার্ড ড্রাইভে রাখা হয়।
আদালতের বক্তব্য, ওএমআর শিট স্ক্যান করা হয়ে থাকলে তা হার্ড ডিস্কে সংরক্ষিত থাকবে। সিবিআইয়ের কাছে কি সেই হার্ড ডিস্ক রয়েছে? যদি হার্ড ডিস্কও নষ্ট করে দেওয়া হয়, তবে সেই বিষয়টিকেও তদন্তের আওতায় আনতে হবে। মেটাডেটা কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এর ডিজিটাল ছাপ রয়েই যায়, যা মোছা যায় না।"
এ ব্যাপারে অকাট্য তথ্য চাইছে আদালত। বিশেষ করে যেখানে কারিগরি বিষয়টি যুক্ত রয়েছে। সেকথা বোঝা গিয়েছে বিচারপতির মন্তব্যে। তিনি বলেন, টেকনিক্যাল ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত না হয়ে আদালত আইনি পদক্ষেপ করতে চাইছে না।
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে তদন্তের এই মোড়ে। প্রথম সার্ভারের কপি কতবার স্থানান্তরিত হয়েছে? তথ্য কি পরিবর্তন করা হয়েছে? পরিবর্তন করা হলে কতবার? এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেতে চায় আদালত। সরকারি, বেসরকারি বা বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের দিকে সিবিআই কতটা এগোল, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে সাত সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে আদালত।
আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, "কোনো ডিজিটাল তথ্য ডিস্ক বা সার্ভার থেকে মুছে ফেললেও তার ছাপ থেকে যায়। সেটা উদ্ধার করা অসম্ভব নয়। অতীতে আদালত একথা বলেছিল। আদালত মনে করছে, শিটের আসল তথ্য উদ্ধার করা গুরুত্বপূর্ণ। সেই নির্দেশ দিয়েছে সিবিআইকে।"
নজরে বেসরকারি সংস্থা
প্রাথমিকে নিয়োগ পরীক্ষার ওএমআর শিট দেখে নম্বর দেওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানিকে। কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি,
এই সংস্থাটির অযোগ্যদের নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইডির নজরে রয়েছেন সংস্থাটির দুই কর্মী পার্থ সেন এবং কৌশিক মাজি। তাদের ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছেন সিবিআই। বুধবার প্রেসিডেন্সি সংশোধবাগারে গিয়ে ইডি আধিকারিকেরা পার্থ ও কৌশিককে জেরা করেন।
এই দুজনের বিরুদ্ধে গত জানুয়ারিতে চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। তদন্তকারীদের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতির মূল কান্ডারিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কৌশিক ও পার্থের। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, অন্যতম অভিযুক্ত কুন্তল ঘোষ ও তাপস মণ্ডলের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সূত্রে দুর্নীতি মসৃণভাবে করা সম্ভব হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি, এস বসু রায় কোম্পানির মাধ্যমে ৭৫২ জন অকৃতকার্য প্রার্থীর অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা যায় মানিক ভট্টাচার্যের কাছে। এর মধ্যে ২৫৬ জন প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন।
এই দাবি আদালতে প্রামাণ্য করতে হলে উত্তরপত্রের মুছে ফেলা তথ্য পেশ করা জরুরি। এই তথ্য বিকৃত করতে সার্ভারে কী বদল করা হয়েছে, তারও জোরালো প্রমাণ পেশ করতে হবে। এই তথ্য উদ্ধারে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা নেয়ার কথা বলেছে হাইকোর্ট।
আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "আদালত সিবিআইয়ের রিপোর্টকে বাতিল করেনি। সেটাকে আরো নিখুঁত করতে বলেছে। হার্ডডিস্ককে যে তথ্য ছিল, তা একেবারে মুছে ফেলা যায় না। তা উদ্ধার করা সম্ভব। সেই তথ্য উদ্ধারের জন্য সব রকমের কারিগরি সাহায্য কেন্দ্রীয় সংস্থাকে নিতে বলেছে হাইকোর্ট।"
এই কাজে এথিক্যাল হ্যাকারদেরও অচ্ছুত রাখতে বলেনি হাইকোর্ট। এরা বৈধ উপায়ে ওয়েবসাইট হ্যাক বা তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন। আদালতের নির্দেশের পরে কি এমন কোনো পদ্ধতিতে মেটাডেটা উদ্ধার করা সম্ভব হবে?