পশ্চিমবঙ্গে জীবন্ত নারীসংহারের দায় নেবে কে?
২৩ মার্চ ২০২২বীরভূমের রামপুরহাটের একটি বাড়ি থেকে মঙ্গলবার সকালে অগ্নিদগ্ধ মানুষদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়৷ উদ্ধারকারী দমকল কর্মী আজিজুল হক জানান, তারা ১০টি পোড়া দেহ উদ্ধার করেছেন৷ তবে রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্যর দাবি, সাতটি দেহ মিলেছে ওই বাড়ি থেকে৷ এই সংখ্যা নিয়ে ধন্দ যেমন কাটেনি, তেমনই সংশয় রয়েছে নিহতদের নাম-পরিচয়ের ক্ষেত্রেও৷ দেহ এতটাই পুড়ে গিয়েছে যে, তা শনাক্ত করতে সমস্যা হয়েছে৷ মৃতদের মধ্যে দুই শিশু ছিল, তা নিশ্চিত৷ ধন্দ থাকলেও গোড়া থেকেই অনুমান করা হচ্ছে, বাকি মৃতদের সকলেই মহিলা, কেননা এলাকার পুরুষরা আগেই প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন৷
রামপুরহাটে নৃশংসভাবে নারী ও শিশু হত্যা প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীকে এর দায় নিতে হবে৷ তিনি মহিলা বা শিশু কেন, কোনো মানুষকেই নিরাপত্তা দিতে পারছেন না৷ ঘটনার পর তড়িঘড়ি সিট গঠন করে দেওয়া হচ্ছে৷ তাতে সুবিচার মিলছে না৷ আনিস খান, তুহিনার ক্ষেত্রে যা হলো, রামপুরহাটেও আমরা তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চলেছি৷’’
পশিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের জেরে এই ভয়াবহ ঘটনা৷ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ খুন হওয়ার পরপরই বগটুই গ্রামেই তার বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা সঞ্জু শেখের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে এই ঘটনাকে শুধু রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে দেখতে চাইছেন না অভিনেত্রী, চিত্র পরিচালক সুদেষ্ণা রায়৷ রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য সুদেষ্ণার বক্তব্য, ‘‘এ ক্ষেত্রে রাজনীতির থেকেও যেটা বলার বিষয়, খুবই অমানবিক এই ঘটনা৷ পুরুষরা গোষ্ঠী সংঘর্ষে যুক্ত, তারা মহিলা ও শিশুদের রেহাই দিচ্ছে না৷ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত৷ আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে রিপোর্ট চেয়েছি৷ প্রশাসনের কাছ থেকে সদুত্তর না পেলে আমরা সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে যাবো৷’’
পশ্চিমবঙ্গে এক দশকের বেশি সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার আমলে চালু হয়েছে একাধিক সরকারি প্রকল্প যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নারীদের৷ কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, নানা প্রকল্পের ‘ফোকাস’ মহিলারা৷ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে বলে রাজ্য সরকারের দাবি৷ সেখানে নারী ও শিশুদের পুড়িয়ে হত্যা কী বার্তা দিচ্ছে? ভারতের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠী টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন সম্পাদক শিখা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরা প্রশাসনকে পরোয়া করছে না৷ হিংসার সময় মহিলা-শিশুদের পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ দিচ্ছে না৷ নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্পকে আমি সমর্থন করি৷ সেই রাজ্যে আবার নারীরাই আক্রান্ত হচ্ছেন৷ এই বিপরীত ছবি কেন, তার জবাব মুখ্যমন্ত্রীকেই দিতে হবে৷’’
এক সময় পশ্চিমঙ্গ ছিল ভারতের নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র৷ আঠেরো-উনিশ শতকে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর সহমরণের রীতি ছিল৷ হিন্দু পরিবারে সদ্যবিধবা নারীকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ফেলে দেওয়া হতো৷ এই বর্বর প্রথা বিলোপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নবজাগরণের পুরোধাপুরুষ রামমোহন রায়৷ বাংলায় সতী প্রথা অতীত, আজ ঘরে-বাইরে নারী সমাজের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো৷ কিন্তু প্রান্তিক, গ্রামীণ ক্ষেত্রে নারীদের সেই জাগরণ কি আজও অধরা? নারী আন্দোলনের কর্মী, রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে নারী-শিশু-বৃদ্ধ, এই ‘অশক্ত’ মানুষরা সাব-টার্গেট হন৷ রামপুরহাটেও তাই হয়েছে৷ তারা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও আক্রমণের মুখে পড়েন৷ নারী ভোটাধিকার পেয়েছে, পদাধিকার পেয়েছে, কিন্তু সঠিক অর্থে নারীমুক্তি আসেনি৷’’
শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী মিরাতুন নাহারের বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মানুষের হিংসা প্রবৃত্তিকে পুঁজি করে৷ তার বলি হয় সাধারণ মানুষ৷ নারীরা যেহেতু এখনো এ দেশে অসহায়, তাই তারা যে কোনো হিংসার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন৷’’ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ কী? গণপ্রতিরোধই পথ, মনে করেন বাংলার নারী সমাজের অগ্রণী অংশের প্রতিনিধিরা৷ তারা মনে করেন, এই প্রতিরোধের সামনের সারিতে থাকতে হবে নারীকেই৷