1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ইস্যু ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’

৪ এপ্রিল ২০১৯

আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে চায় বিজেপি৷ দলের সভাপতি অমিত শাহ সম্প্রতি এই মন্তব্য করায় রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে বিতর্ক৷

https://p.dw.com/p/3GF3h
ছবি: DW/P. Samanta

ভারত ভাগের পর জনতার একাংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন৷ আবার ভারত থেকেও একাংশ পূর্ব পাকিস্তানে গেছেন৷ বহু মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছেন৷ এই স্থানান্তর এক অর্থে বাধ্যতামূলকই ছিল৷

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের সময় যে পরিস্থিতি, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বিতর্কের যোগ নেই৷ ১৯৪৭ সালের বহু পরেও দেখা গিয়েছে, সীমান্ত দিয়ে মানুষের যাতায়াত থামেনি৷ বিভিন্ন কারণে অসংখ্য মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে৷ গোড়া থেকেই বিজেপির বক্তব্য, বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে৷ সেই অনুপ্রবেশে এখনও লাগাম টানা যায়নি৷ তাই জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি তৈরি করে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হবে৷ 

‘সন্ত্রাসবাদীরা এর পিছনে আছে কি না দেখতে হবে’

নির্বাচনের মরসুমে এই বিষয়টি ফের সামনে আনছে বিজেপি৷ দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ আগেও এ কথা বলেছেন৷ সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের এক সভায়ও তিনি বলেন, আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে৷ বিজেপি যদি ফের ক্ষমতায় আসে তাহলে অবৈধভাবে ভারতে বসবাসকারীদের বিতাড়িত করা হবে৷

নানা মত

অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রচারের পেছনে তাদের রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে৷ বাংলাদেশ থেকে এপারে আসা মানুষদের সিংহভাগই যেহেতু সংখ্যালঘু, তাদের প্রসঙ্গ সামনে এনে নির্বাচনে সমর্থন বাড়াতে চাইছে তারা৷

অনুপ্রবেশ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান এতটা কঠোর নয়৷ আসামে এনআরসি নিয়ে তারা তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল৷ তৃণমূলের ভাষায়, নাগরিকপঞ্জি আসলে বাঙালিদের দেশছাড়া করার অপচেষ্টা৷ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ভারত থেকে একজন বাঙালিকে বের করে দেওয়া যাবে না৷ ধর্মের নামে ভেদাভেদ করতে দেওয়া হবে না৷ ভোটের মুখে সে কথাটাই জোরের সঙ্গে বলছে তৃণমূল৷

কলকাতা পুরনিগমের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রেহানা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিজেপি হিন্দু-মুসলমানের ভেদ তৈরি করতে চাইছে৷ সে কারণে এই ইস্যু তুলছে৷ আমরা ভেদাভেদে বিশ্বাস করি না৷ সবাই মিলেমিশে থাকি৷ আমার ওয়ার্ডকে তাই মিনি ইন্ডিয়া বলে৷'' 

রেহানা যে এলাকার জনপ্রতিনিধি, সেখানে নানা জাতি-ধর্মের মানুষের বাস৷ কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কাছে মহম্মদ আলি পার্কের আশেপাশে অবাঙালি অধ্যুষিত এই এলাকা৷ সেখানকার দীর্ঘদিনের কাউন্সলির রেহানার বক্তব্য, ‘‘কাউকে তাড়িয়ে দেব বলা সহজ৷ তার পাশে দাঁড়ানো বড় কথা৷ কেউ আমার দেশের বিরুদ্ধে কাজ করলে তাকে সাজা দিতে হবে৷ কিন্তু, সবাইকে দুষ্কৃতিকারী বললে চলবে না৷''

বিজেপি অবশ্য একে ভেদাভেদের রাজনীতি বলে মানতে রাজি নয়৷ তারা বলছে, যে-কোনো উপায়ে অনুপ্রবেশ রুখতে হবে৷ নইলে এখানকার মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়বে৷ বুধবার পশ্চিমবঙ্গে একটি জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের অনুপ্রবেশকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন৷ বিজেপির অভিযোগ, অনুপ্রবেশকারীদের বৈধতা দিয়ে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতে চাইছে তৃণমূল, তাতে আখেরে দেশের ক্ষতি হচ্ছে৷

বিজেপির কৃষক নেতা রামকৃষ্ণ পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছে, অনুপ্রবেশের ফলে তাদের ক্ষতি হচ্ছে৷ রুটি-রুজিতে ভাগ বসাচ্ছে বিদেশ থেকে আসা মানুষরা৷ এর ফলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে৷ এমনকি রাজনৈতিক ভারসাম্যও বদলে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক জয়-পরাজয় নির্ধারিত হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের ভোটে৷ দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে বিষয়টি জড়িত৷ বিজেপি তাই অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর৷ এটা কথার কথা নয়৷''

বাংলাদেশ থেকে বহু হিন্দু ভারতে এসেছে৷ তারাও কি অনুপ্রবেশকারী নয়? এ ক্ষেত্রে বিজেপি নেতার বক্তব্য, ‘‘শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে পার্থক্য আছে৷ রাষ্ট্রপুঞ্জের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর দেশে নিরাপত্তার অভাববোধ করেন, তাহলে তিনি অন্য দেশে আশ্রয় নিতে পারেন৷ তাঁকে শরণার্থী হিসেবে দেখতে হবে৷ তাই অমুসলমানরা শরণার্থী৷ কিন্তু, বাংলাদেশের কোনো মুসলিম নাগরিক তাঁর দেশে অত্যাচারের মুখে পড়ে ভারতে আসছেন, এটা হতে পারে না৷ তাই তাঁকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে৷''

উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালের ‘শরণার্থী কনভেনশন' অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় সব দেশের শরণার্থীনীতি নির্ধারিত হয়৷ এই চুক্তিতে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র সই করলেও ভারত করেনি৷ সে কারণে ভারতে আসা শরণার্থীরা কেউই আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুযোগ-সুবিধা পান না৷ শুধু তাই নয়, ভারতের আইন অনুযায়ী, কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া, ভারত ভাগের পরবর্তী কিছু বছরে আসা মানুষদের ‘রিফিউজি সার্টিফেকেট' বা শরণার্থীপত্র প্রদান করা হতো, যা আজ আর প্রচলিত নেই৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, এই নতুন ‘বাংলাদেশি শরণার্থীর' সংজ্ঞা আসলে কী?

ভোটার কার্ডে সমস্যা

বনগাঁ, বসিরহাট ইত্যাদি সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় বসবাসকারী অনেকেরই পরিচয়পত্র নেই বিভিন্ন কারণে৷ বিজেপির এনআরসি ইস্যুতে তাঁরাও যথেষ্ট শঙ্কিত এবং ভোটার কার্ড সংগ্রহের জন্য তৎপর৷ বনগাঁ লোকালের নিত্যযাত্রী আমিনা বেগম বলেন, ‘‘এখান থেকে চলে যেতে বললে তো মুশকিল৷ তার চেয়ে ভোটার কার্ডে নাম তোলার চেষ্টা করব৷'' সে ক্ষেত্রে ভোটার কার্ডে নাম তোলা কতটা সহজ হবে? কাউন্সিলর রেহানা খাতুন জানান, ‘‘অনেকে বিহার, ইউপি থেকে এসেছেন, বিয়ে করে সংসার করেছেন৷ কিন্তু কোনো ভোটার কার্ড নেই৷ এদের সবাইকেই আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার কার্ডের কথা বলেছি৷ এছাড়াও যাদের কার্ড নেই, তাদেরও ভোটারকার্ড করতে বলছি৷ লোকসভা মিটে গেলে পুজোর পর থেকে আবার ভোটার কার্ডে নাম তোলার ব্যবস্থা শুরু করব৷'' 

‘বাংলার মানুষ বুঝতে পেরেছে, অনুপ্রবেশের ফলে তাদের ক্ষতি হচ্ছে’

অনুপ্রবেশ যখন ইস্যু

পশ্চিমবঙ্গের জনসমষ্টির এক চতুর্থাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের৷ তারা প্রধানত তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক বলে মনে করা হয়৷ তার বিপরীতে যে সিংহভাগ সংখ্যাগুরু ভোট, তা একজোট করতে চাইছে বিজেপি৷ সে কারণেই অনুপ্রবেশের ইস্যুকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি৷ এমনটাই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের৷

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল বলেন, ‘‘বেআইনিভাবে কেউ এ দেশে বসবাস করলে তাকে চিহ্নিত করা যেতেই পারে৷ কিন্তু, এটাকে ভোটের ইস্যু করে তোলা কাম্য নয়৷ আসামে বিজেপি তাদের ইশতাহারেই বলেছিল নাগরিকপঞ্জির কথা৷ পশ্চিমবঙ্গেও অনুপ্রবেশের সমস্যা রয়েছে৷ এখানেও তারা সেই ইস্যু তুলছে৷''

অনুপ্রবেশের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত বলে মত অধ্যাপক অনিন্দ্যর৷ তিনি বলেন, ‘‘বেআইনিভাবে যারা ভারতে আছে, তারা কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন৷ সন্ত্রাসবাদীরা এর পিছনে আছে কি না দেখতে হবে৷ বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর তদন্তে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজশের তথ্য উঠে এসেছিল৷ কী পরিস্থিতি বা উদ্দেশ্যে এ দেশে কেউ ঢুকে পড়ল, সেটা বিচার করা জরুরি৷''

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷