পশ্চিমবঙ্গে লোক টানতে ব্যর্থ হলেন মোদী
৫ এপ্রিল ২০১৯কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে রাজনৈতিক সমাবেশ করা এবং সেই সভা ভরিয়ে তোলা যে-কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই অত্যন্ত গর্ব এবং আত্মশ্লাঘার ব্যাপার৷ লোকে এখনও মনে করতে পারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাশে নিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক সমাবেশ, লোকসংখ্যার হিসেবে যা সর্বকালের রেকর্ড হয়ে আছে৷ অথবা ১৯৮৯ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ডাকে ব্রিগেডে সর্বভারতীয় বিরোধী জোটের সমাবেশ৷ অথবা ২০১১ সালে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির সভা৷ সেই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সভা করা এবং ওই বিশাল ময়দান লোকে ভরিয়ে তোলা যে নেহাত সহজ কাজ নয়, সেটা আগেও একবার বুঝেছিল বিজেপি৷ এবছরই ফেব্রুয়ারিতে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্রিগেডের সভার কর্মসূচি ঘোষণা করেও পিছিয়ে এসেছিল৷ কারণ, তার আগের মাসেই মমতা ব্যানার্জির সভায় বিপুল জনসমাগম হয়েছিল৷ তার সঙ্গে মোদীর সভার ভিড়ের যে তুলনা হবেই, সেটা বিজেপি নেতৃত্ব অনুমান করতে পেরেছিলেন৷ এবং ভরসা ছিল না নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির ওপর৷ ফলে মোদীর সভা বাতিল হয়েছিল৷
এবারেও কিন্তু মুখরক্ষা হলো না বিজেপির৷ যদিও চেষ্টার কসুর হয়নি৷ জেলায় জেলায় সভা করে কলকাতার সভা ভরানোর কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল৷ যদিও গ্রীষ্মকাল এখনও আসেনি, কাজেই রোদ চড়া নয়, কিন্তু মাঝেমধ্যেই ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সেই অজুহাতে ব্রিগেডের বিশাল মাঠের একটা অংশে খাটানো হয়েছিল অতিকায় হ্যাঙার৷ জার্মান উপাদান, প্রযুক্তি এবং নির্মাণকৌশলে রাতারাতি গড়ে তোলা, মাথা ঢাকা এই হ্যাঙারে ঠিক কতজন লোক ধরে, তার নির্দিষ্ট কোনো হিসেব দেয়া হয়নি৷ এবং যেহেতু হ্যাঙারের তিনদিকও আচ্ছাদিত, দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে কতজন লোক নরেন্দ্র মোদীর টানে ব্রিগেডে হাজির হয়েছিলেন৷ কলকাতা পুলিশের তরফে সরকারিভাবে কোনো সংখ্যা না বলা হলেও পুলিশি অনুমান, সংখ্যাটা আড়াই লাখ ছাড়াবে না৷ বাম নেতারা, যাঁরা ব্রিগেড ভরাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন একদা, তাঁদের ধারণা আরও কম, মেরেকেটে লাখ দুয়েক৷ একমাত্র বিজেপি নেতারা বলছেন পাঁচ-ছয় লাখ লোক হয়েছিল মোদীর সভায়৷ বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, অন্তত সাত-আট লাখ লোক এসেছিল৷ আর ক্যামেরার নীচু অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা বিজেপির নিজস্ব প্রচারচিত্রে জনসমুদ্র মনে হয়েছে সেদিনের ব্রিগেডকে৷
ফলে মোদীর ভাষণও তেমন জমল না৷ ইদানীং ভারতীয় রাজনীতির যা চল হয়েছে, রাজনীতি বাদ দিয়ে, মূল ইস্যু বাদ দিয়ে শুধুই ব্যক্তি আক্রমণ, এবারও তাই হলো৷ মোদী আক্রমণ করলেন মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে, যিনি এই মুহূর্তে সর্বভারতীয় বিজেপিবিরোধী রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি৷ মোদী বললেন, সারা দেশ উন্নতি করছে দ্রুতগতিতে, কিন্তু বাংলা করছে না৷ কারণ বাংলায় একজন ‘স্পিড-ব্রেকার' আছেন৷ দিদি৷ তাঁর কাছে এসে কেন্দ্রের সমস্ত জনকল্যাণ প্রকল্পের গতি ব্যাহত হয়ে পড়ছে৷ বললেন, বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার পরাক্রমে যখন সারা দেশ গর্বিত, খুশি, তখন পাকিস্তানের দুঃখে কাতর বাংলার দিদি৷ তিনি বালাকোট সেনা অভিযানের সাফল্যের প্রমাণ চাইছেন, কজন জঙ্গি ওই হামলায় মারা গেছে, তার হিসেব চাইছেন৷
কলকাতার আগে এদিন মোদীর সভা ছিল উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে৷ সেখানেও মোদী ব্যক্তি আক্রমণের রাস্তাতেই হাঁটেন৷ আর তার জবাবে কোচবিহারের দিনহাটায় ওইদিনই মমতা ব্যানার্জি মোদীর নামকরণ করেন ‘এক্সপায়ারি বাবু'৷ কেন্দ্রে মোদী সরকারের এক্সাপায়ারি ডেট যে হয়ে গেছে, সেটা এবারের ভোটের প্রচারে প্রায় স্লোগান বানিয়ে নিয়েছেন মমতা৷ কিন্তু তাঁর পালটা বক্তব্যও কার্যত ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি তর্জা হয়েই থেকে গেল৷
পশ্চিমবঙ্গে এবার পাঁচ দফায় লোকসভা ভোট হওয়ার সূচি ঘোষিত হওয়ায় সবিশেষ উল্লসিত হয়েছিলেন বিজেপির নেতারা৷ তখনই তাঁরা বলেছিলেন, এতে প্রধানমন্ত্রী মোদী স্বয়ং এই রাজ্যে ভোটের প্রচারে অনেক বেশি সময় দিতে পারবেন, বার বার আসতে পারবেন৷ কারণ বিষয়টা অস্বস্তিকর হলেও সত্যি, যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখনও তাদের নিজস্ব কোনো নেতা তৈরি করতে পারেনি, যাঁর ডাকে লোকে আসবে, যাঁর কথা শুনবে৷ অগত্যা মোদীই ভরসা৷ কিন্তু এইরকম ফ্লপ শো'য়ের পর মোদী নিজেই আর কতবার পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে আসতে উৎসাহিত হবেন, সেটাই এখন দেখার৷