সংবাদ সম্মেলন না করা প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোদী
১৩ মার্চ ২০১৯মোদীর সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদকাল আর মাত্র আড়াই মাস৷ এরমধ্যে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে সামনে আসবেন বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা৷
শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির নেতাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সখ্যতা সেই শুরু থেকেই৷ কিন্তু, ওসবের ধার ধারেন না মোদী৷ সরকারের শীর্ষে থেকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ধাতে নেই৷ বরং তা এড়িয়েই চলেন তিনি৷ গত ৫ বছরে একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি তিনি৷ তবে, মাঝেমধ্যে পছন্দের সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলে ‘সাজানো' প্রশ্নের জবাব দিতে দেখা গেছে তাঁকে৷
মৌন মোদী
গত পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান, কৃষক দুর্দশা, গো-রক্ষা, দলিত নিপীড়ন, গণপিটুনির মতো বিষয়গুলিতে মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন মোদী৷ নোটবন্দি, পণ্য ও পরিসেবা কর, হালের সীমান্তে উত্তেজনার ইস্যুতেও সংসাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেছেন মোদী৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কার্যত দেউলিয়া করে পগার পার হওয়া মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া ও নীরব মোদীদের নিয়েও ‘নীরব’ থেকেছেন তিনি৷ এজন্য তাঁকে ‘মৌন মোদী’ আখ্যা দিয়েছে বিরোধী শিবির৷ অথচ, সরকারি হোক বা দলীয়, জনসভায় বরাবরই গলা চড়াতে পছন্দ করেন নরেন্দ্র মোদী৷
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর আজ অবধি একটিও সাংবাদিক সম্মেলন করেননি মোদী৷ কয়েক বছর আগেও যাঁকে ‘মৌন মোহন সিং' বলে কটাক্ষ করা হত, সেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বছরে অন্তত দু-বার সাংবাদিক সম্মেলন করতেন৷ এমনকি তাঁর বিদেশ সফরে সঙ্গী হতেন সাংবাদিকরা৷ বিমানে সংবাদমাধ্যমকে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিতেন তিনি৷
এ পর্যন্ত ৪০ বার বিদেশ সফর করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ কিন্তু সঙ্গে নেননি বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে৷ প্রথা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের বিমান মাশুল দিত সরকার৷ কিন্তু, বিদেশে সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হত নিজেদের খরচে৷ মোদী ক্ষমতায় এসে সে সব বন্ধ করেছেন৷ যদিও এই বিষয়ে সরকারের বক্তব্য, ‘‘জনগণের করের অর্থ অপচয় রুখতেই এমনটা করা হয়েছে৷’’
কিন্তু, নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী গুটিকতক সাংবাদিক সরকারের কর্মকাণ্ড নিজের চোখে দেখে সংবাদ পরিবেশন করতেন৷ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনাও করতেন৷ সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ আমলাদের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ মেলার ফলে বহু অজানা তথ্য প্রকাশ পেত৷ ‘ব্যয় কমানো’র অজুহাতে সেসব বন্ধ করা ঠিক কতটা যুক্তিগ্রাহ্য? একি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলা নয়? প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পাওয়া নয়?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এই অনভিপ্রেত নীরবতা নিয়ে মুখ খুলেছেন মনমোহনও৷ বলেছেন, ‘‘আমি কখনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম না৷ মুখ খোলার জন্য উনি (মোদী) আমাকে যে উপদেশ দিতেন, এখন সেটা ওঁর নিজের ওপর প্রয়োগ করে দেখানো উচিত৷'' সম্প্রতি নিজের লেখা ‘চেঞ্জিং ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেওছেন সেকথা৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত হাজরা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘মিডিয়ার এই দশার জন্য দায়ী ভারতীয় মিডিয়াই৷ কারণ, রাহুল গান্ধী বা বিরোধী নেতাদের পেছনে ফেলে দিয়ে একতরফাভাবে মোদীর সমালোচনা শোনা যায়৷ অথচ বিরোধী নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি নিয়ে চুপ থাকে মিডিয়া৷ সরকারি খরচে সাংবাদিকরা বিদেশে গিয়ে কোনো চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন করেছেন, এমনটা শোনা যায় না৷ তাই প্রথা অনুযায়ী জনগণের করের টাকায় সাংবাদিকদের বেড়াতে নিয়ে গেলেও কোনো রাজকার্য সিদ্ধ হত না৷’’
কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকতা করছেন, এমন প্রবীণ সাংবাদিকদের মতে, নরেন্দ্র মোদী আসলে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছেন অত্যন্ত সুকৌশলে৷ জাতীয় সংবাদমাধ্যম তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না৷ অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন৷
অভিযোগ, দেশে ‘প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো’ স্বীকৃত সাংবাদিকরা যে-কোনো মন্ত্রণালয়ে অবাধ যাতায়াত করতে পারতেন৷ এখন তা-ও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ আগাম জানাতে হয়, কোন আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করতে চান৷ ফলে, স্বভাবতই সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন আমলারাও৷ সমূলে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সাংবাদিককূলের চিরপরিচিত ‘সোর্স’৷
একাধিক প্রবীণ সাংবাদিক জানিয়েছেন, মোদীর আগে সব প্রধানমন্ত্রী (অটলবিহারী বাজপেয়ীও) একজন ‘মিডিয়া উপদেষ্টা’ নিয়োগ করতেন৷ এখন তা-ও নেই৷ সংসদের সেন্ট্রাল হলে, যেখানে সাংবাদিকরা মন্ত্রী ও সাংসদদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতেন, সেখানেও একজন নিরাপত্তা আধিকারিক নিয়োগ করা হয়েছে৷ তাঁর কাজ হলো, সাংবাদিকদের সঙ্গে কে কে কথা বলছেন, তার তালিকা তৈরি করা৷ এমতাবস্থায় সরকার যা জানাবে তাই জানতে হবে, সরকার যা চাইবে, তাই সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করতে হবে - এমন একটি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলেছে৷ আসলে মোদী স্বতন্ত্র সাংবাদিকতকায় বিশ্বাস করেন না৷
এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় দিল্লিতে কর্মরত জাতীয় সংবাদপত্রের প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্ন পছন্দ করেন না, যা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য মোটেই ভালো নয়৷ তবে, যে-কোনো বিষয়ে মোটেই মৌন থাকেননি মোদী৷ তিনি কোথায়, কখন বলবেন সেটা নিজেই বেছে নিয়েছেন৷’’
ভোটের মুখে প্রকল্পের ছড়াছড়ি
ভারতে লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগে মাত্র ৩০ দিনে মোট ১৫৭টি প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ প্রতিদিন গড়ে ৫টি৷ যার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সড়ক, মেডিকেল কলেজ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, গ্যাসের পাইপলাইন, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ এবং নিকাশি-সহ বহু প্রকল্প৷ এসবের বেশিরভাগই পুরনো, অর্থাৎ, হয় চালু হয়েছে, নয়তো চালু হওয়ার পথে বা আগেই শিলান্যাস হয়েছে৷
যেমন উত্তরপ্রদেশের আমেঠিতে (কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর নির্বাচনি কেন্দ্র) রাশিয়ার সহায়তায় অত্যাধুনিক এ কে-২০৩ রাইফেল তৈরির কারখানার উদ্বোধন করেছেন মোদী৷ কিন্তু এই প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছিল ২০০৭ সালে৷ ২০১০ সাল থেকে সেখানে কার্বাইন, রাইফেল এবং ইনসাস মেশিনগান তৈরি শুরু হয়েছে৷
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিহারের করমালিচকে একটি নিকাশি প্রকল্পের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী৷ সেটিও নতুন প্রকল্প নয়৷ ২০১৭-র অক্টোবরেই সেই একই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে কারমালিচক নিকাশি প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন তিনি৷ অথচ, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে এইভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা করেননি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং৷
পুরনো প্রকল্প পুনরায় উদ্বোধন করা ছাড়াও, এমন অনেক প্রকল্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর নাম জড়িয়েছে, যা তাঁর পদমর্যাদার সঙ্গে খাপ খায় না৷ কী কী সেগুলি? প্রায় ১৪০টির কাছাকাছি এমন প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন, যা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার কোনো ব্যক্তিত্ব উদ্বোধন করছেন, এমনটা ভাবা যায় না৷ সেগুলির মধ্যে রয়েছে চেন্নাই মেট্রোর এক অংশে যাত্রী পরিসেবা চালু৷ কর্ণাটকের চিকজজুর-মায়াকোন্ডা রেললাইনের ডাবলিং৷ তামিলনাড়ুতে ৪ নম্বর জাতীয় সড়কে ছয় লেনের সম্প্রসারণ৷ কিছু প্রকল্পতো স্থানীয় কোনো নেতা উদ্বোধন করার উপযুক্ত৷ উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ পুরসভায় একটি গোশালা সংস্কারের শিলান্যাস, নিকাশি নালার উদ্বোধন, ইত্যাদি৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত হাজরা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘মোদী সব জায়গায় যাচ্ছেন, প্রকল্প উদ্বোধন করছেন৷ শুধুই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন, এমনটা নয়৷ পুরনো প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন মোদীর আগে অনেকেই করেছেন৷’’
আর প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা বলছেন, ‘‘গত ৫ বছরে মোদী অনেক বড় বড় ঘোষণা করেছেন৷ খুব ভালো কাজ হয়েছে বলা যাবে না৷ আবার সড়ক, রেল, বিমান পরিসেবা, আয়ুষ্মান যোজনায় কাজ করেছেন৷ বেশিরভাগ কাজ হয়েছে গত এক বছরে৷ এটা সত্যি যে অনেক প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন৷ এইসব প্রকল্প কোন সরকার বাস্তবায়ন করবে, তা কারও জানা নেই৷’’