বিবাহবিচ্ছেদ বিপজ্জনক
২০ অক্টোবর ২০১৪মাসুমা সারা খান এই রকমই এক মেয়ে৷ মাত্র ২৫০ ডলারের বিনিময়ে এক পুরুষের কাছে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাঁর মা-বাবা৷ তাঁর বয়স তখন ১১ বছর৷ ‘‘এই বিয়েটা ভালোবাসার বা পরিবারের ঠিক করা কোনোটাই ছিল না৷ আমাকে একটা খেলনার মতোই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল৷ আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসেননি৷ আমিও চেয়েছিলাম মা-বাবাকে সন্তুষ্ট করতে৷'' জানান আজকের ২২ বছর বয়সি মাসুমা৷ ১১ বছরের বিবাহিত জীবনের পর বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন মাসুমা৷ এর কারণ স্বামীর বড় ভাই-এর দ্বারা যৌন নির্যাতন৷ ‘‘একই বাড়িতে তার সঙ্গে বসবাস করা যায় কীভাবে? আমার তো মান-সম্মান হারানোর একটা ভয় আছে'', বলেন তরুণী৷
বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটা আজও শেষ হয়নি৷ কিন্তু জীবনযাত্রা জটিল হয়ে যাচ্ছে মাসুমার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমার স্বামীকে ত্যাগ করার পর বাবা-মা আশ্রয় দেননি৷ আমি একটি বাড়ি ভাড়া করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ একা কোনো মেয়েকে ভাড়া দিতে রাজি হননি৷ এখন আমি দুই সন্তান নিয়ে এক বান্ধবীর বাসায় আশ্রয় নিয়েছি৷'' বলা বাহুল্য, বিশেষ করে পশতু জাতির রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনকে খারাপ চোখে দেখা হয়৷ পুরুষদের ক্ষেত্রে এতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না৷
ঘটে থাকে হত্যাকাণ্ডও
পশতু গায়িকা ঘাজালা জাভেদকে ২০১০ সালে তাঁর স্বামী হত্যা করেন৷ এর কারণ স্বামীর আগের এক স্ত্রী রয়েছে এই খবরটা জানার পর তালাক চেয়েছিলেন তিনি৷ ঘাজালা জাভেদের শোকাহত মা এই খুনের সঠিক বিচার পাবেন বলে আশা করেন৷ মাসুমা খানও ন্যায় বিচারের দাবি জানান৷ তাঁর ঘটনাটি হাই কোর্টে নিয়ে গেছেন তিনি৷
মাসুমার আইনজীবী আহমেদ সেলিম খান জানান, গত ১০ বছরে বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেক বেড়ে গেছে৷ ২০১২ সালে পেশোয়ারের আদালতে ১,০০০-এরও বেশি বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা হয়েছিল৷ ১৯৯৮ সালে সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৮০৷ এর কারণ মেয়েরা এখন তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন৷ সেলিম খানের ভাষায়, ‘‘মিডিয়ার মাধ্যমে মেয়েরা জানতে পারেন যে, দাম্পত্য জীবনে সহিংসতা দেখা দিলে তালাক নেওয়ার অধিকার তাঁদের আছে৷ এ জন্য তাঁরা আদালতে যান৷''
স্থানীয় ইসলামি সংগঠন পেশোয়ারের জামিয়া দারওয়াইশ-এর কাছে অনেক দম্পতি বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে যান৷ সংস্থাটির একজন ইসলাম বিশারদ মুফতি আব্দুল কাদের দম্পতিদের তালাক নেওয়ার ব্যাপারে নিরুত্সাহিত করেন৷ ‘‘বিবাহ বিচ্ছেদ সমাজ, জাতি ও পরিবারকে ধ্বংস করে৷ ইসলামে বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখা হয় না এবং মনে করা হয় যে একমাত্র আর কোনো উপায় না থাকলেই বিচ্ছেদের পথে যাওয়া যেতে পারে'', বলেন এই ইসলামবিদ৷
ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমোদন রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে স্বামী পরিত্যক্তা নারীর মর্যাদা সমাজে খুব কম৷ পুরুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য রকম৷ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০১২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী পাকিস্তান সেই সব দেশের মধ্যে একটি, যেখানে নারী পুরুষের বৈষম্য সবচেয়ে বেশি৷
আউরাত ফাউন্ডেশনের তত্পরতা
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠন আউরাত ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, দাম্পত্য জীবনে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করার কারণে শুধু গত বছরেই ৮,০০০-এরও বেশি নারী খুন হয়েছেন৷
‘‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে হবে, মেয়েদের ওপর এই রকম একটা নৈতিক চাপ দিয়ে থাকে আমাদের সমাজ, সে যাই ঘটুক না কেন৷ এটা একটা বড় ভুল''৷ বলেন আউরাত ফাউন্ডেশনের সাবিনা আইয়াজ৷ বিশেষ করে অনেক মা-বাবার আচরণও খুব খারাপ বলে মনে করেন তিনি, যাঁরা পারিবারিক সহিংসতার কবলে পড়লেও বিবাহিত মেয়ের কোনো দায় দায়িত্ব নিতে চান না৷
বড় বড় শহরে অবস্থাটা ভাল
করাচি ও লাহোরের মতো বড় বড় শহরে মেয়েদের অবস্থা আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা ও পেশোয়ারের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলকভবে ভালো৷ বড় শহরের মেয়েরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারেন৷ আইনজীবী ও আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন তাঁরা সহজে৷
আউরাতের মতো সংস্থাগুলি বিশেষ করে রক্ষণশীল এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে৷ তাদের জন্য বিশেষ কোর্সের আয়োজন করছে, যেখানে শেখানো হয়, পারিবারিক সহিংসতার শিকার মেয়েদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করা উচিত৷ একই সাথে নারী অধিকারবাদীরা পাকিস্তানের আইনজীবীদের লিঙ্গ বৈষম্য ও দাম্পত্য জীবনে সহিংসতার ব্যাপারে সচেতন করতে চান৷ এছাড়া আউরাত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের নিখরচায় আইনগত সহায়তাও দেওয়া হয়ে থাকে৷
কিন্তু তবুও মাসুমার মতো ভুক্তভোগীদের সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়৷ ছাড়াছাড়ির পর স্বামীর কাছ থেকে সন্তানদের জন্য আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে ততটা উদ্বিগ্ন নন মাসুমা৷ তাঁর বড় আশঙ্কার কথা জানালেন তিনি এভাবে: ‘‘বাড়িতে থাকলে আমি ভয় পাই, কেউ হয়ত আমাকে খুন করতে আসবে৷ আর বাইরে গেলে অ্যাসিড হামলার আতঙ্কে থাকি৷''