তথ্যকল্যাণীদের বিশ্বজয়
১৬ জুন ২০১৩মাহফুজা আক্তার হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু পরিবারের আর্থিক অক্ষমতা তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি৷ আবার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে একজন মেয়ের পক্ষে নিজের এলাকায় কাজ পাওয়াটাও সহজ ছিল না৷ তবে মাহফুজার ভাগ্য ভালো৷ গাইবান্ধার এই মেয়ে ২০১০ সালে নিজের এলাকায় ‘তথ্যকল্যাণী' হিসেবে কাজ পেয়ে যান৷ বিশেষ এই কাজের জন্য প্রয়োজন একটি সাইকেল, কিছু তথ্য-প্রযুক্তি ও চিকিৎসা উপকরণ এবং সর্বোপরি সাংগঠনিক দক্ষতা৷
উষ্ণ অভ্যর্থনা
একটি ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরা এবং ইন্টারনেট সংযোগযুক্ত মোবাইল ফোন নিয়ে মাহফুজা নিজের এলাকায় কাজ করেন৷ সাইকেলে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন ২৫ বছর বয়সি এই যুবতী৷ মূলত তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন সেবা, যেমন তাঁর এলাকার কারো সঙ্গে স্কাইপ-এর মাধ্যমে বিদেশে বা অন্য শহরে বসবাসরত কারো যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া কিংবা কৃষককে তথ্য দিয়ে সহায়তা বা গ্রামের কোনো শিক্ষিত তরুণকে চাকুরির আবেদন লিখতে সহায়তা করার মতো কাজগুলো মাহফুজা নিয়মিতই করছেন৷ পাশাপাশি গ্রামের অন্তঃসত্ত্বা নারীটিকে বিভিন্ন সাধারণ চিকিৎসা সহায়তাও করেন তিনি৷ গ্রামবাসীকে প্রয়োজনে আইনি সহায়তাও প্রদান করেন মাহফুজা আক্তার৷
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মাহফুজার মতো তথ্যকল্যাণীরা যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেন, সেসব অঞ্চলে চিকিৎসকরা তেমন একটা যান না বললেই চলে৷ ফলে এসব অঞ্চলের মানুষ আগে ছোটখাট শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা নিতে গিয়েও বিপাকে পড়তেন৷ তথ্যকল্যাণীরা এখন তাদের সহায়তা করছেন৷ আর তাঁদের পেছনে কল সেন্টারে রয়েছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দল৷ ফলে যে কোনো সময় কল সেন্টারে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে পারেন তথ্যকল্যাণীরা৷
মাহফুজার মতো তথ্যকল্যাণীরা এসব সেবা বিনা খরচায় দেননা৷ আবার নির্দিষ্ট কোনো ফিও তাদের নেই৷ মাহফুজা এই বিষয়ে বলেন, ‘‘ক্ষেত্র বিশেষে আমরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অর্থও পেয়ে থাকি৷ অনেকসময় সেবাগ্রহীতা আমাদের দুপুরের খাবারের জন্যও আমন্ত্রণ করে৷''
মাহফুজা বলেন, ‘‘আমি সাধারণ মানুষকে সেসব কাজ করতে উৎসাহী করি, যা তারা স্বাভাবিকভাবে একরকম অসম্ভব মনে করে৷ ফলে গ্রামের মানুষ অনেক সময় আমাদের শিক্ষক বা চিকিৎসকদের চেয়েও বেশি মর্যাদা দেয়৷''
নারীর কাছে পৌঁছানো
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷ ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বের তুলনা করলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এই হার অত্যন্ত কম৷ মোটের উপর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের তথ্য সহায়তা প্রদানে সরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও সেগুলো খুব একটা সাড়া ফেলতে পারছে না৷ তবে তথ্যকল্যাণীরা এক্ষেত্রে বেশ সফল৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডিনেট-এর উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসেন এই বিষয়ে বলেন, ‘‘তথ্যকল্যাণীদের সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা অনেকটা শহরের বাসিন্দাদের মতোই এখন বিভিন্ন তথ্য এবং অন্যান্য সেবা পাচ্ছেন৷''
২০০৭ সালে বাংলাদেশে ‘তথ্যকল্যাণী' প্রকল্প চালু করে ডিনেট৷ বর্তমানে সারা দেশে ৭০ জন তথ্যকল্যাণী কাজ করছেন৷ মূলত নারী ও শিশু এবং প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠরা তাঁদের সেবার আওতায় রয়েছেন৷
তথ্যকল্যাণীরা সবাই নারী৷ তবে এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়৷ মোশাররফ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘নারীদের নিজেদের মধ্যে সহায়তার পরিধি বাড়াতে এবং তাঁদের আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলতেই এই প্রকল্প৷''
মাহফুজার পক্ষে তথ্যকল্যাণী হিসেবে কাজ শুরু করাটা সহজ ছিল না৷ তাঁকে এজন্য রীতিমত পরীক্ষায় অবতীর্ন হতে হয়েছে৷ বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষক থেকে শুরু করে বেকার অবধি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তিনি কতটা মানিয়ে চলতে পারবেন, সেটা মূল্যায়ন করা হয়েছে কঠোরভাবে৷ ডিনেটের আয়োজিত ৩০ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পর মাহফুজা এই কাজের জন্য উপযুক্ত হয়েছেন৷
তথ্যকল্যাণী হিসেবে কাজ করে সন্তুষ্ট মাহফুজা৷ এখনও তিনি মনে করতে পারেন সেদিনের কথা, যেদিন নিজের প্রথম উপার্জনের টাকা তুলে দিয়েছিলেন মায়ের হাতে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মা সেদিন কেঁদে ফেলেছিল৷''
বর্তমানে প্রতি মাসে মাহফুজা গড়ে দশ হাজার টাকার মতো আয় করেন৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনযাপনের জন্য এই আয় সন্তোষজনক৷
‘একটি বিপ্লবী প্রকল্প'
বাংলাদেশের এই তথ্যকল্যাণী প্রকল্প ডয়চে ভেলের ‘দ্য বব্স – বেস্ট অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড ২০১৩' জয় করেছে৷ ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম' বিভাগে জুরি অ্যাওয়ার্ড জয় করে এই প্রকল্প৷ দ্য বব্স-এর জুরি শহীদুল আলম এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এটা এক বিপ্লবী প্রকল্প যা সমাজ, সংস্কৃতি এবং ডিজিটাল যুগের মধ্যকার ব্যবধান দূর করতে ভূমিকা রাখছে৷ তথ্যকল্যাণীদের কারণে এখন অনেক মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন৷''
তথ্যকল্যাণী প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতারাও এই প্রকল্প সম্পর্কে দারুণ আশাবাদী৷ মোশাররফের কথায়, ‘‘এই প্রকল্প আর্থিক এবং সামাজিক – উভয় দিক বিবেচনাতেই টেকসই৷'' বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তথ্যকল্যাণী প্রকল্পকে অনন্য এবং টেকসই হিসেবে আখ্যা দিয়েছে৷ ফলে তথ্যকল্যাণীরা সহজ শর্তে ব্যাংকঋণও নিতে পারছেন৷
উল্লেখ্য, ডিনেট ২০১৭ সাল নাগাদ তথ্যকল্যাণীদের সংখ্যা বাড়িয়ে ১২,০০০ করতে চাচ্ছে৷ বাংলাদেশের পাশাপাশি কঙ্গো, রুয়ান্ডা এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও এই প্রকল্পকে ছড়িয়ে দিতে চায় তাঁরা৷ এই লক্ষ্যে কাজ চলছে এখন৷