1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পাচারের টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে: পরিকল্পনামন্ত্রী

১২ জুন ২০২২

বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে ‘সাধারণ ক্ষমার’ ঘোষণা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে৷ এমনকি সরকারের মধ্যেও এটা নিয়ে দ্বিমত আছে৷

https://p.dw.com/p/4Cagd
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি: Imago/blickwinkel

পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেও পাচারের টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে বলে মনে করেন৷কিন্তু অর্থমন্ত্রী মরিয়া৷

বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগ বলেছে, এক বছরে সন্তোষজনক টাকা ফেরত না এলে এই সুযোগ আর নয়৷ ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের যে টাকা ফেরত আনতেই হবে তা নয়৷ বিদেশে থাকা স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির উপর নির্ধারিত হারে কর দিলেও তা বৈধ বলে গণ্য হবে৷ আর এটা করলে তারা ফৌজদারী মামলা থেকেও রেহাই পাবেন৷

অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তাফা কামাল বাজেটবক্তৃতায় পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ফেরত না আনলে শতকরা ১৫ ভাগ কর দিতে হবে৷ অস্থাবর সম্পত্তি ফেরত না আনলে ১০ ভাগ কর দিতে হবে৷ আর রেমিটেন্স আকারে ফেরত আনলে সাত শতাংশ কর দিতে হবে৷

এই সুযোগ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুনপর্যন্ত বহাল থাকবে৷ সিপিডি, টিআইবি, এফবিসিসিআই, আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এই সুযোগের সমালোটনা করেছেন৷ তারা বলেছেন, এটা ন্যায়-নীতি বিরোধীই শুধু নয়, এর ফলে ঘুস-দুর্নীতি উৎসাহিত হবে, টাকা পাচার আরো বাড়বে এবং সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন৷

দুর্নীতি রুখতে কি দুদক ব্যর্থ?


টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার যেভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে চাইছে তা অনৈতিক, বেআইনি, দুর্নীতি সহায়ক এবং বৈষম্যমূলক৷''

‘‘সরকার যেভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে চাইছে তা অনৈতিক’’

তার কথায়: 
১. এটা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অনৈতিক৷ কারণ ২০১২ সালে অর্থ পাচার বিরোধী যে আইন করা হয় তাতে বলা হয়েছে পাচার করা অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, পাচার করা অর্থের দ্বিগুণ পরিমান জরিমানা হবে এবং চার বছর থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ড হবে৷


২. এটা বৈষম্যমূলক, কারণ যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, আয় করেন তাদের সর্বোচ্চ শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়৷ অবৈধভাবে আয় করে পাচার করে ফেরত আনলে কর শতকরা সাত ভাগ৷ এটা শুধু বৈষম্যমূলক নয়, যারা অসৎ তাদের পুস্কৃত করা হচ্ছে৷এতে পাচার বাড়বে এবং সৎ লোকরা নিরুৎসাহিত হবেন৷

৩. যারা অর্থ পাচার করেছেন তারা সাত শতাংশ কর দিয়ে টাকা ফেরত আনবেন এটা সরকারের অলীক চিন্তা৷ এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নাই৷ যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন তারা সেটা সেখানে রাখা এবং ভোগ করার জন্যই করেছেন৷

৪. এটা যদি তাদের বৈধ আয় হতো তাহলে তাদের সাত শতাংশ কর দেয়ার প্রশ্ন আসত না৷ কারণ বাংলাদেশি যারা বিদেশে বৈধভাবে আয় করেন তারা বিনা ট্যাক্সেই টাকা দেশে পাঠাতে পারেন৷ সুতরাং যে টাকার কথা বলা হচ্ছে সেটা অবৈধ আয়৷

তাই তিনি মনে করেন, সরকার চাইলেই এই টাকা ফেরত আনতে পারবে না৷ এরজন্য আন্তর্জাতিক আইন আছে, দেশে আইন আছে৷ সেই আইনে অর্থ পাচার গুরুতর অপরাধ৷ সেই আইন মেনেই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে৷ বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে৷ সিঙ্গাপুর থেকে আইন মেনেই পাচারের অর্থ ফেরত আনার নজির আছে৷

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, সরকার যে পদ্ধতিতে পাচার করা অর্থ দেশে আনতে চায় তাতে দেশে ঘুস-দুর্নীতি উৎসাহিত হবে৷ কারণ পাচার করা অর্থ অবৈধভাবে আয় করা হয়েছে৷ দুর্নীতি ও ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে তা দেশে বাইরে পাচার করা হয়েছে৷

দুর্নীতির সাথে পাচারও উৎসাহিত হবে: ড. মইনুল ইসলাম

তিনি বলেন, ‘‘এটা অনৈতিক৷এতে পাচার না কমে বরং বাড়বে৷ দুর্নীতির সাথে পাচারও উৎসাহিত হবে৷ আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি উৎসাহিত হবে৷ বৈধভাবে আয় করলে কর হবে উচ্চ হারে৷ অবৈধভাবে আয় করলে কর হবে কম৷ এটা তো দুর্নীতির পক্ষে যায়৷ এটা কালো টাকা সাদা করার আরো বড় সুযোগ৷

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে৷ টাকাতো হাতছাড়া হয়ে গেছে, দেশের টাকা বিদেশে চলে গেছে, সরকার ট্যাক্স পায়নি৷ সরকার তো নিরুপায়৷ অসহায় বলব না, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে৷ তাই একটি সুযোগ দিয়ে দেখা যদি কিছু ফেরত আসে৷ বড়শি যখন আমরা পানিতে ফেলি তখন আশা করি মাছ ধরবে৷ তা না হলে আমরা বড়শি ফেলব কেন?''

টাকা তো হাতছাড়া হয়ে গেছে: পরিকল্পনামন্ত্রী

তার কথায়, ‘‘অনেকে বলেন ঝুঁকি আছে৷ ঝুঁকি তো আছেই৷ কেউ বলছেন, ভালো মানুষরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন৷ ব্যবসা বণিজ্যে ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ বলে কোনো কথা নেই৷ ব্যবসা করে লাভের আশায়৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশাবাদী নই৷ তবে চেষ্টা করতে আপত্তি কী? যদি কিছু পাওয়া যায় এই আশায় সরকার এই কাজটি করছে৷ টাকা তো বেরিয়ে গিয়েছে৷ আমরা কি মোড়ল দেশগুলোর সাথে পারবো?''

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এর আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয় এই কথাই স্বীকার করতেন না৷ এবার বাজেটের মাসখানেক আগে থেকে তিনি তা স্বীকার করা শুরু করেন৷ আর বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরদিন তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিরোধিতা না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘‘টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে, সরকার তা ফেরত আনার চেষ্টা করছে৷ যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের হক৷ যদি বাধা দেই তবে আসবে না৷ যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি৷ ১৭টা দেশ অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরত এনেছে৷''

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে কত টাকা এখন পর্যন্ত পাচার হয়েছে তার হিসাব সরকারের কাছে নেই৷ তবে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷ আর সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেখানে বাংলাদেশিদের টাকা জমা আছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০৩ কোটি টাকা৷

সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া থেকে এখন অবধি মোট আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷