পার্মাকালচার বা টেকসই কৃষি
২৩ জানুয়ারি ২০১৮ফ্রান্সের সেরা বিকল্প কৃষি খামারটি পাওয়া যাবে নর্মান্ডি অঞ্চলে৷ শার্ল ও তাঁর স্ত্রী পেরিন অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার ২০০৩ সালে জমিটুকু কিনে সেখানে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষ করার পরিকল্পনা করেন৷ পেরিন শোনালেন, ‘‘আমরা যখন শুরু করি, তখন সবাই বলত, অরগ্যানিক পণ্য দিয়ে তো আর সারা দুনিয়ার খিদে মেটানো যাবে না৷ আমরা কিন্তু ঠিক তাই ভাবতাম৷ তবে প্রাথমিকভাবে আমরা নিজেদের ও আমাদের পরিবারবর্গের জন্য অরগ্যানিক খাবারের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম৷'' শার্ল অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার যোগ করলেন, ‘‘গোড়ায় আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না৷ লোকে ভাবত, আমরা শহর থেকে আসা দুই ভাবুক৷ কিন্তু ধীরে ধীরে ওরা আমাদের বাগানের ফলন দেখে চমকে গেছে৷''
পেরিন প্রথমে অরগ্যানিক পদ্ধতিতে চাষের চেষ্টা করেন, কিন্ত তা বিশেষ সফল হয়নি৷ তখন তিনি পার্মাকালচার আবিষ্কার করেন, যার উৎস অস্ট্রেলিয়ায়৷ পার্মাকালচারের লক্ষ্য হল কৃষিতে বিভিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘বায়োজিওকেমিক্যাল' বৃত্ত সৃষ্টি করা, যেগুলি তাদের পরিবেশকে নিজের মতো করে গড়ে নেয় ও তা থেকে বাঁচতে পারে৷ শার্ল ও পেরিন এভাবে বর্তমানে ১,৪০০ বর্গমিটার জমিতে প্রায় ৭০ ধরনের সবজির চাষ করেন৷
পেরিনের ভাষ্যে: ‘‘এখানে কোনো মোনোকালচার নেই৷ আমাদের এখানে সবসময় নানা ধরনের সবজি একসঙ্গে চাষ করা হয়, ভারসাম্য রক্ষার জন্য যা খুব দরকার৷ কাজেই এখানে স্যালাডের সঙ্গে ফুল আর পেঁয়াজ বসানো হয়, কেননা পেঁয়াজের গন্ধে স্যালাডের পোকারা পালায়৷ কেন? খুব সোজা: স্যালাডের পোকারা দেখতে পায় স্যালাড, কিন্তু শোঁকে পেঁয়াজ! তাতে তারা ঘাবড়ে যায়৷ কাজেই সবজিরা নিজেরাই পরস্পরকে বাঁচায়৷''
স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃত্ত
প্রত্যেকটি গাছ বা উদ্ভিদ পোকাদের টানে৷ অপরদিকে অন্যান্য জীবজন্তু পোকা খেয়ে পোকার সংখ্যা কমায়৷ বিরল পাখিরা আবার ফিরে আসতে শুরু করে৷ বেক এলুঁই খামারে পরাগ ছড়ানোর কাজটা মৌমাছিরা নয়, ভোমরারা করে৷ বাগানটা একটা ঝর্ণার ধারে৷ বনের পশুপাখিরা এখানে স্বচ্ছন্দ বোধ করে; সবজি চাষ থেকে যা পড়ে থাকে, তাতেই তাদের চলে যায়, কিছুই নষ্ট হয় না৷ এভাবেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃত্ত তৈরি হয়৷ সার অথবা যন্ত্রের ব্যবহার এখানে নিষিদ্ধ৷ উঁচু ঢিবির মতো সবজির খেতগুলোতে শুধুমাত্র ঝারি দিয়ে পানি দেওয়া যায়৷
শার্ল অ্যার্ভ-গ্রুইয়্যার ব্যাখ্যা করলেন: ‘‘প্রথমে একটা ঢিবি করা হয়; তার ওপরে খুব ঘন করে চারাগাছ বসানো হয়, এমনকি বেশ উঁচু সব চারা৷ এর ফলে গাছেদের একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে৷ নীচের মাটি শিকড়-বাকড়ে ভরে যায়৷ প্রত্যেকটি ঢিবির ওপর একটা মাইক্রো-ক্লাইমেট সৃষ্টি হয়৷ বৃষ্টি হলে মাটি জলে ভেসে যায় না, কেননা শিকড়-বাকড়ে তা ধরে রাখে; ঐ মাটি আবার জীবনে ভরপুর: কেঁচো, জীবাণু, শ্যাওলা৷ আর প্রত্যেকটি ঢিবির এই নিজস্ব ‘জলবায়ুর' ফলে প্রতিবার চাষের সঙ্গে সঙ্গে জমি আরো উর্বর হয়ে ওঠে৷''
বৌদ্ধদের ‘মান্ডালা' চক্রের আকারে সবজির খেত করার আইডিয়াটা শার্ল পেয়েছেন এশিয়া থেকে৷ সূর্যের সর্বোচ্চ অবস্থানের কথা মনে রেখে ক্ষেতগুলো কাটা হয়েছে৷ এছাড়া জমির স্বাভাবিক এবড়ো-খেবড়ো আকৃতিও ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর ফলে কোদাল চালিয়ে পুরো ক্ষেতটা নতুন করে তৈরি করতে হয়নি৷ শার্ল জানালেন, ‘‘এই খামারে আমরা গড়ে প্রতি বর্গমিটার জমি থেকে ৫৫ ইউরো ফসল পাই৷'' যা কিনা ট্র্যাক্টর দিয়ে চাষ করা প্রথাগত সবজির খামারের প্রায় দশ গুণ!
ভবিষ্যতের কৃষি?
বেক এলুঁই কি তাহলে ভবিষ্যেৎ কৃষির আদর্শ? প্যারিসের জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানের কৃষি বিশেষজ্ঞ ফ্রঁসোয়া লেজার একটি ন'বছর ব্যাপি জরিপে সেটাই পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন৷ জরিপের ফলাফল: বেক এলুঁইতে যে পরিমাণ সবজি ফলে, তা অনুরূপ আয়তনের একটি প্রথাগত খামারের তুলনায় প্রায় তিন থেকে চার গুণ৷
জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানের ছাদের বাগানে বেক এলুঁই-এর এই আশ্চর্য সাফল্যের কারণ অনুসন্ধান করছেন লেজার৷ তিনি দেখেছেন, ‘‘প্রথমত প্রতিটি ক্ষেতে একাধিক ধরনের সবজির চাষ করা হয়৷ বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে সংযোগের ফলে ফলন বাড়ে৷ হাতে করে চারা বসালে, ঘন করে চারা পোঁতা যায়; সেজন্যও ফলন বাড়ে৷ প্রতিটি গাছ যে বেশি ফল দেয়, এমন নয়, কিন্তু গাছের সংখ্যা অনেক বেশি৷ আর যত বেশি গাছ, তত বেশি ফলন৷''
বেক এলুঁই-এর লাভের আরেকটা কারণ: এখানে চাষবাসের খরচা অনেক কম৷ ১৫ জন কর্মচারী আছে বটে, কিন্তু কোনো দামি ট্র্যাক্টর বা যন্ত্রপাতি নেই৷ কৃত্রিম সার, কীটনাশক ও সেচের খরচও বাঁচে৷ খামারের ঘাসপাতা দিয়েই সবজির ক্ষেতগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়৷ তার ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ে৷
বেক এলুঁই খামারের নাম ইতিমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এক টুকরো পোড়ো জমি থেকে এরকম একটি নিসর্গ সৃষ্টি করা মুখের কথা নয়৷ সেই নিসর্গ আবার টেকসই, প্রায় নিজে থেকেই চলে৷
মোনিকা কোভাকসিক্স/এসি