‘পাহাড়িদের আস্থায় নিয়েই ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে’
২৭ জুন ২০১৭ডয়চে ভেলে: সম্প্রতি পার্বত্য এলাকায় যে ঘটনাটা ঘটে গেল, দেড়শ'র বেশি মানুষ মারা গেল, এ অবস্থা তো একদিনে তৈরি হয়নি৷ তাহলে সমাধান করা যাচ্ছে না কেন?
অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন: পুরো জিনিসটা যদি আমরা মাথায় নেই তাহলে আমাদের বুঝতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে অস্থিরতার সময়৷ তখন বাঙালিদের নিয়ে ওখানে সেটেল করা হয়েছে৷ সেটেল করা হয়েছে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স ছাড়াই৷ পাহাড়ের ভূমি আর সমতল ভূমি যে এক প্রকৃতির না, সেটা বুঝতে হবে৷ এটা কিন্ত কখনোই আমরা আমলে নিইনি৷ তখন সরকারের তরফ থেকে বারবার যুক্তি দেখানো হচ্ছিল, পাহাড়ে অনেক জমি খালি পড়ে আছে সে কারণেই বাঙালিদের ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ পাহাড়ে আসলে ভূমি কখনোই খালি পড়ে ছিল না৷ যে জমিগুলো দেখানো হয়েছে, সেটা আবাসের জন্যও ঠিক ছিল না, ফসল করার জন্যও ঠিক ছিল না৷ ইকোলজিক্যাল ভারসাম্যের কথা চিন্তা না করেই আমরা খালি বলতে শুনলাম, ভূমি খালি পড়ে আছে৷ ওখানে যে বাঙালিদের নেয়া হয়েছে, তাঁদের প্রতিও অন্যায় করা হয়েছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনগোষ্ঠীর উপরও অন্যায় হয়েছে৷ ওদের যে ইকোলজি সেটার প্রতি তো চরমভাবে হয়েছে৷ সেটারই মাশুল দিচ্ছি আমরা৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নে যে মডেল আছে, সেখানে কি তাহলে কোনো ত্রুটি আছে?
অবশ্যই ত্রুটি আছে৷ কারণ, আপনি যে উন্নয়ন করছেন, সেটা তো পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করতে হবে৷ এ কথাটা তো বারবার বলা হচ্ছে৷ এখন না, যখন বাঙালিদের ওখানে প্রথম নেয়া হলো তখনকার পার্লামেন্টের ‘ডিবেট' যদি আমরা দেখি, সেখানে বলা হয়েছে, পার্বত্য এলাকার মানুষ উন্নয়ন চান না৷ তাঁরা অলস, কাজও করতে চায় না৷ কথাটা তো ঠিক না৷ ওঁরা তো উন্নয়ন ঠিকই চায়৷ এই উন্নয়নটা তো তাঁদের প্রকৃতির সঙ্গে মিলতে হবে৷ সেটা তো পরিবেশবান্ধব হতে হবে৷ সেটা তো হয়নি৷ সেখানে এটা একটা বড় ত্রুটি৷ ওখানে যে ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে, সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, লেখালেখি হয়েছে৷ আমরা মনে হয় না এটা সেভাবে আমলে নেয়া হয়েছে৷
সাম্প্রতিক পাহাড়ধ্বসের পর ভূমি অধিকারের বিষয়টা সামনে চলে এসেছে...
ভূমি অধিকারের বিষয়টা তো আসবেই৷ এটা সব সময় এসেছে৷ আমি তো শুরু থেকে বলছি, ওদের নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিটা আছে, সেটা আমলে নিয়েই আমাদের এগুতে হবে৷ ওদের নিজস্ব আইন আছে, সামাজিক আইন আছে, কিন্তু আপনি তো ওখানে অন্য ধরনের আইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন৷ আপনি যখন সেটেলমেন্টে যাবেন, তখন আপনাকে তো সবকিছু মাথায় রেখেই করতে হবে৷
সাম্প্রতিক যে বিপর্যয়টা ঘটে গেল, এটাকে কি আমরা প্রকৃতিক না মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় বলব?
আমার মনে হয়, মূলত মনুষ্যসৃষ্ট, তারপর প্রাকৃতিক৷ যেসব জায়গায় এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেখানে মানুষকে সেটেল্ড করা ঠিকই হয়নি৷ আপনি পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছেন, এটার তো কোনো দরকার ছিল না৷
পার্বত্য এলাকায় বাড়ি-ঘর নির্মাণে কি কোনো ধরনের নীতিমালা আছে?
এটা আমি বলতে পারি না৷ ওদের বড়ি-ঘরগুলো ভিন্ন অবকাঠামো দিয়ে তৈরি৷ ওখানে এ, বি, সি – এই তিন ক্যাটাগরির ল্যান্ড আছে৷ সব ক্যাটাগরিতে আপনি বাড়ি-ঘর নির্মাণ করতে পারেন না৷ আমার মনে হয় না সেটা ফলো করা হয়েছে৷
সব সরকারই ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তির কথা বলে আসছে, তাহলে এটা হচ্ছে না কেন?
ভূমির মালিকানা কার, এটা তো আমরা সমাধান করতে পারছি না৷ মালিকানার একটা বিরাট ব্যাপার আছে৷ আর আইনে পরিবর্তন আনতে হবে৷ এটা না আনা পর্যন্ত আমরা এ সমস্যার সমাধান তো আমরা করতে পারব না৷ বাংলাদেশ সরকার যেটাকে খাস জমি বলছে, পাহাড়িরা সেটাকে বলছে তাদের গোত্রভুক্ত জমি৷ এটার মধ্যে তো একটা সামঞ্জস্য আনতে হবে, তাই না?
দ্য চিটাগাং হিলট্র্যাক্টস রেগুলেশন অনুযায়ী, সেখানকার জমির মালিক সরকার৷ তাহলে একজন উপজাতির অধিকারে কি কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না?
চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশনে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ল্যান্ড আছে৷ এই রেগুলেশনে পাহাড়িদের জমির অধিকার দেয়া হয়েছে৷ ঔপনিবেশিক সময়ের কথা যদি ধরেন, তাহলে সব জমির মালিকানা তো সরকারেরই ছিল৷ তখনও আদিবাসীদের জমির উপর মালিকানা ছিল৷ কিছু কিছু জমি তারা আলাদা করে নিয়েছিল ফরেস্টের জন্য৷ কিছু ছিল ফরেস্টের জন্য, কিছু ছিল উন্নয়নের জন্য৷ সেখানে একটা ধারাই ছিল যে, ডিসি চাইলে কাউকে সেখান থেকে বের করে দিতে পারবেন৷ বাইরে থেকে অভিবাসনটা সে সময় রেস্ট্রিকটেড ছিল৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম তো পর্যটন এলাকা৷ ভূমি বিরোধের কারণে তো পর্যটন অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
এটা তো হবেই৷ দেখুন ভুটানও কিন্তু পর্যটন এলাকা৷ সেখানে তো ওরা অনেক কিছু মেনেই পর্যটন করে৷ আমরা যেটাকে বলি ইকো টুরিজম৷ এটা তারা করে৷ পার্বত্য চট্টগ্রমেও ইকো টুরিজমই করতে হবে৷
ভূমি সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? আপনার পরামর্শ কী?
আমার মনে হয়, আলাপ-আলোচনা ছাড়া এটা হবে না৷ এখানে পাহাড়িদের অন্তর্ভূক্ত করেই তাঁদের যাঁরা কমিউনিটি লিডার আছে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং তাঁদের যে ইনস্টিটিউশন আছে, পার্বত্য চুক্তির পর যেগুলো হয়েছে, তাদের নিয়ে সবাই মিলেই সমাধান করতে হবে৷ তাঁদের তো পুনর্বাসন করতে হবে, তা না হলে তো আর হবে না৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷