পায়ে জাদু, বুকে ভালোবাসা
৮ জুন ২০১৮খেলা কি কেবল বাণিজ্য কিংবা নিছক বিনোদন? সমাজে এর প্রভাব আর কী কী! ২০১০ সালের বিশ্বকাপ শেষে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘ফিরিয়ে দাও খেলা' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়৷ সে সংবাদে উঠে আসে বিশ্বকাপের মাসটিতে ঢাকায় ইভটিজিং কমেছিল ৯০ শতাংশ৷ আর খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস কমেছিল আগের মাসগুলোর তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ৷
ফুটবলের এই পরোক্ষ জোরটা সম্ভবত ফিফা জানে৷ আর সে কারণেই নানা সমাজসেবামূলক ক্যাম্পেইনের সাথে ফুটবলকে যুক্ত করার প্রয়াস শুরু হয়েছে৷ বিশেষ করে শিশুদের জন্য নানা ধরনের সেবামূলককাজে ফুটবলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তহবিল সংগ্রহের কাজ হামেশাই চলে৷ ২০০৬ সালে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এবং ফিফা ‘ইউনাইটেড ফর চিলড্রেন, ইউনাইটেড ফর পিস' ক্যাম্পেইন শুরু করে৷
ওই ক্যাম্পেইনে ফুটবলের সেই সময়ের তারকা টোগোর ইমানুয়েল আবিদিওর, জার্মানির ক্রিস্টফ মেডজেদা, আইভরি কোস্টের দিদিয়ের দ্রগবা, ফ্রান্সের থিয়েরি অঁরি, অ্যামেরিকার টিম হাওয়ার্ড, মেক্সিকোর রাফায়েল মারকেস, আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, জাপানের হিডোটোশি নাকাতা, জি-সুং পার্ক, ইকুয়েডরের এডউইন টেনোরিও, ইটালির ফ্রান্সিসকো টোট্টি, হল্যান্ডের এডউইন ভন ডার সার, কোস্টারিকার পাওলো ওয়ানচোপে এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ডোয়াইট ইয়র্ককে যুক্ত করা হয়৷
অসুস্থ বাচ্চাদের সাহায্যার্থে কাজ করা দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘মেক এ উইশ' ফাউন্ডেশনকে ২০১৩ সালে রোনাল্ডো এক নজিরবিহীন উপহার দেন৷ ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের ট্রফিটির রেপ্লিকা তিনি নিলামে তুলে দেন৷ বিক্রির ৬ লাখ ইউরোর পুরোটাই দান করেন ‘মেক এ উইশ' ফাউন্ডেশনকে৷ জানেন তো, প্রতিষ্ঠানটির কাজ কী! মৃত্যু পথযাত্রী শিশুদের ইচ্ছা পূরণ করা৷
আর ২০১২ সালে রোনাল্ডো তাঁর মূল গোল্ডেন বুট ট্রফিই চ্যারিটিতে দান করেন ফিলিস্তিনের শিশুদের সহায়তা করতে, যার মূল্য ছিল প্রায় দেড় মিলিয়ন ইউরো৷ ২০১৬ সালে রোনাল্ডো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর বোনাস হিসেবে পাওয়া পুরো অর্থই দান করেছিলেন চ্যারিটিতে৷
ফুটবলার রোনাল্ডো ইউনিসেফ, সেই দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিসনসহ আরও বেশ কিছু এনজিও এবং সাহায্য সংস্থার সাথে যুক্ত আছেন৷ তাঁর নিজ গ্রাম মেদেইরার উন্নয়নেও বেশ সহযোগিতা করেছেন৷ ২০১৫ সালে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দানশীল ক্রীড়াবিদ ঘোষিত হয়েছিলেন৷
জার্মান ফুটবলার মেসুট ও্যজিলেরও রয়েছে একই ধরনের ইতিহাস৷ ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে তিনি আয় করেছিলেন ২ লাখ ৩৭ হাজার পাউন্ড৷ ব্রাজিলের ২৩ জন শিশুর চিকিৎসায় ওই অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল৷
ফুটবলারদের এই দানশীলতার তালিকায় মেসি ও নেইমারও আছেন৷ ২০১০ সালে হাইতি ভূমিকম্পের পর নিজের ব্যস্ত সূচি দূরে ঠেলে মেসি ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে৷ তাঁর বসবাসের স্থান রোজারিও শহরের শিশুদের একটি হাসপাতাল গড়ার কাজে অনুদান দিয়েছেন ৬ লাখ ৭০ হাজার ইউরো৷ এছাড়া বারবার এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন দাতা সংস্থার আহ্বানে৷
ব্রাজিলের ফুটবল তারকা নেইমারও পিছিয়ে নেই৷ খেলোয়াড়দের সমাজ সেবামূলক কাজের ভিত্তিতে যে তালিকা তৈরি হয়, তাতে নেইমারের নাম ২০১৫ সালে চলে এসেছিল ৫ নম্বরে৷ নেইমার পরে বলেছিলেন, তিনি সমাজসেবামূলক কাজ করতে ভালোবাসেন, কেননা, এ ধরনের কাজ আরও বেশি গোল করার জন্য তাকে উৎসাহিত করে৷ তিনি আরও বেশি মনোযোগ দেন এবং জয়ের চেষ্টা করেন৷
গত সপ্তাহে মাস্টারকার্ড একটি বিতর্কিত ক্যাম্পেইন চালু করে৷ তারা ঘোষণা দেয়, নেইমার ও মেসির প্রতি গোলের জন্য ১০ হাজার শিশুকে খাদ্য সরবরাহ করবে৷
তীব্র সমালোচনা শুরু হয়৷ কেননা, মাস্টারকার্ডের হাতে শিশুদের দেওয়ার মতো খাবার থাকা স্বত্ত্বেও অভুক্ত শিশুদের কিনা খাবার পেতে অপেক্ষা করতে হবে দুই ফুটবলারের গোলের জন্য! এটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বিপণন ‘আইডিয়া' হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ৷ ফলে ক্যাম্পেইনটি মাস্টারকার্ড প্রত্যাহার করে৷ তার বদলে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১০ লাখ শিশুকে বিনামূল্যে একবেলা খাবার সরবরাহের ঘোষণা দেয়৷
মেসি আর রোনাল্ডো অবশ্য প্রস্তুত ছিলেন গোলের জন্য৷ কেননা, নিঃসন্দেহে তাঁরা বড় মাপের ফুটবলার, কিন্তু বড় মাপের মানুষও তো বটে! তাঁদের পায়ে রয়েছে জাদু, বুকে রয়েছে ভালোবাসা৷
এইচআই/এসিবি