পিটুনি থেকে বাঁচতে তায়কোয়ান্দো শিখছেন ডাক্তাররা!
২৭ মার্চ ২০১৮পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং রমরমিয়ে চলছে ডাক্তার নিগ্রহ৷ রোগী মৃত্যুর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে ভাঙচুরের পাশাপাশি ডাক্তারদের উপরে আকছার হামলা হয়৷ এমার্জেন্সি বিভাগে কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তাররাই এসবের মুখে পড়েন বেশি৷ এর বিহিত করতে তাঁরা প্রায়ই ধর্মঘটে বসেন৷ বন্ধ হয়ে যায় পরিষেবা৷ আবার ইদানীং অন্য পরিস্থিতিও দেখা দিচ্ছে৷ জুনিয়র ডাক্তাররাই মারমুখো হয়ে যাচ্ছেন৷ কিন্তু এবার রোগীর পরিবারের হাত থেকে সরকারি ডাক্তারদের আত্মরক্ষার জন্য স্বাস্থ্যকর্তারা এবার সরাসরি তায়কোয়ান্দো শেখার পরামর্শ দিয়েছেন৷ সরকারি হাসপাতালে জোরকদমে প্রশিক্ষণ চলছে এই মার্শাল আর্টের৷ যেন ‘দাঁতের বদলে দাঁত' কিংবা ‘মারের বদলে মার' নীতি!
কিছুদিন আগে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মৃতের পরিজনদের আলাদা করে ডেকে নিগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ অভিযোগের তীর উঠেছে জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধেই৷ এর ওপর তাদের তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ যে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে না, তা কে বলতে পারে! ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলে অধিকাংশ ডাক্তার এমনটাই জানালেন৷
হাসপাতালে জরুরি পরিষেবা না থাকলেও ডাক্তার নিগ্রহ চলে, আবার রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও ডাক্তার পেটানো হয়৷ তার সুরক্ষার্থে ডাক্তাররা শিখছেন তায়কোয়ান্দো! পুরো ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর বলে মন্তব্য করলেন সিপিএম নেতা এবং বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুয়াদ হালিম৷ তাঁর মতে, চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর নিবিড় সম্পর্কই হিংস্র বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ তাই এমন জুডো, ক্যারাটে শেখার বিচিত্র প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে৷ তায়কোয়ান্দো শিখিয়ে আদৌ কোনও ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রমাণ হচ্ছে, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র চিকিৎসা পরিষেবাকে বলিষ্ঠ করতে পারছে না৷ উল্টে মূল সমস্যা থেকে দূরে যেতে চাইছে৷''
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের তরফ থেকে ডা. রেজাউল করিম সরকারের এমন পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছেন৷ কেউ এমনিই তায়কোয়ান্দো শিখতেই পারেন, কিন্তু সরকার থেকে শেখানো হবে কেন? ৩০ বছর চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকা এই চিকিৎসকের মতে, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার বা শয্যা নেই, চিকিৎসার খরচ বেশি৷ সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভকে রাজনীতি উল্টোদিকে চালিত করছে৷ পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতে বাজেট কমে যাচ্ছে৷ এরকম পরিস্থিতিতে তায়কোয়ান্দো শেখালে হাসপাতালে যুদ্ধ পরিস্থিতি হতে চলেছে৷ সেটা সামলাতে তখন র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স নামাতে হবে৷ তায়কোয়ান্দো না শিখিয়ে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়ানো উচিত৷ পরিকাঠামোর উন্নতি না করে তায়কোয়ান্দো শিখিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টাকে আত্মঘাতী পদক্ষেপ বললেন এই চিকিৎসক৷
আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই আছে৷ পাশাপাশি তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নাকি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলাতেও দরকার৷
স্বাস্থ্যকর্তাদের এমন দাবিরবিপক্ষে ডা. করিম বলেন, ‘‘যাঁরা তায়কোয়ান্দো শেখানোর কথা বলছেন, তাঁরা গজদন্ত মিনারে বসে সুখস্বপ্ন দেখছেন৷''
মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরও তো খেলাধুলো বা যোগাভ্যাসের নিয়ম রয়েছে৷ কী বলছেন জুনিয়র ডাক্তাররা? ইএসআইসি মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ডা. অর্ণব কুমার পালের মতে, সমস্যা মেটাতে যদি তায়কোয়ান্দো শেখানো হয়, তবে তা কোনও কাজের না৷ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বেহাল অবস্থা থেকে তুলে না এনে তায়কোয়ান্দো শেখালে সমস্যা মিটবে না মোটেই৷ আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (কলকাতা) যুগ্ম সম্পাদক অর্ণব বলেন, ‘‘গত বছর ৮১ জন ডাক্তারের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে৷ এতে বোঝাই যাচ্ছে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক আর আগের মতো নেই৷ রোগী মৃত্যুতে ডাক্তার দায়ী বলে প্রচার করা হচ্ছে৷ ডাক্তারদের সুরক্ষা না দিয়ে, এসব সমস্যার গভীরে না গিয়ে খামতির ওপর দিয়ে স্রেফ তায়কোয়ান্দোর মলম দিয়ে কী হবে?''
অ্যামেরিকার পেনসিলভানিয়ায় বন্দুকবাজদের আটকাতে স্কুল শিক্ষকদেরও সঙ্গে বন্দুক রাখতে বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ এ রাজ্যে চিকিৎসকেরাও শিখলে অসুবিধে কোথায়? এমন যাঁরা বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কৌশিক দাস বললেন, ‘‘‘দুটোর পরিপ্রেক্ষিত আলাদা৷ ওদেশে বন্দুকের অপব্যবহার হচ্ছে৷ আর এ রাজ্যে আর্থসামাজিক আর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের ভিলেন বানানোর প্রচার চলছে৷ যেটা আজ থেকে ১০ বছর আগেও ভাবা যেতো না৷ আজকে ডাক্তার নিগ্রহ বা তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আদতে সমাজেরই ক্ষতি হচ্ছে৷ ডাক্তাররা আজ পথে নেমে আন্দোলন করছেন, এতে বোঝা যায়, সমাজ কোনদিকে যাচ্ছে৷'' তিনি প্রশ্ন তুললেন, ‘‘তায়কোয়ান্দো দিয়ে কি আত্মরক্ষা সম্ভব? একজন ডাক্তারকে দশজন ক্ষিপ্ত মানুষ ঘিরে ধরলে তিনি কি নিজের সুরক্ষা করতে পারবেন?'' বরং মানুষকে লড়াইয়ে ইন্ধন না জুগিয়ে শুভবুদ্ধিতে আইনের হাত শক্ত করে ধরা হোক, এমনটাই মনে করেন এই চিকিৎসক৷
আর ভুক্তভোগী জনতা কী বলছেন? বেলঘরিয়ার হিমাংশু গুপ্ত, গড়িয়ার ঋতু দে সহ অনেকেরই মতে, শুভবুদ্ধি সবাইকেই জাগাতে হবে৷ ডাক্তাররা রোগী দেখার ক্ষেত্রে শুধু অর্থের বিবেচনা করবেন কেন? বেশি দামের ওষুধ লিখবেন কেন? তাঁরা হাসপাতালের দুর্নীতির সহায়ক হবেন কেন? সেটাও যেমন পাল্টাতে হবে, তেমনি মারামারির ভাবনাও দূর করতে হবে৷ অনেকে আবার ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের মধ্যে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ শুনে প্রকাশ্যে হেসে ফেলছেন৷ দু' পক্ষের বিবাদের মধ্যেই সরকারি তরফে উন্নতি দেখানো হচ্ছে৷ অধিকর্তারা বলে চলেছেন, গত কয়েক বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে, আগামীতেও হবে৷ উন্নতির এমন নজির হলে ভবিষ্যতে ডাক্তারি কোর্সে ও অন্তর্ভুক্ত হবে নাকি?