পেঁয়াজ আমদানি না করলে বাঁচতো কৃষক
১৫ মে ২০২০নিজেদের বাজার সামাল দিতে গত বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ভারত প্রথমে পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বেঁধে দেয়৷ তাতেই বাংলাদেশের বাজারে রাতারাতি এ নিত্যপণ্যটির দাম কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল৷ ২৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেশী দেশটি রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করলে দেশের বাজারে রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়ে যায়৷ এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম তখন ২৫০ টাকার উপরে উঠেছিল৷
প্রায় পাঁচ মাস পেঁয়াজের বাজারে এ আগুন অবস্থা ছিল৷ তুরস্ক থেকে আমদানি করে এবং কৃষকরা আগাম পেঁয়াজ তুলে বাজার সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি৷
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷ পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারেও স্বস্তি ফেরে৷ কমতে থাকে পেঁয়াজের দাম৷ কিন্তু ওই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মার্চের শেষের দিকে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার নিজ নিজ দেশে লকডাউন ঘোষণা করে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়৷
প্রায় দেড় মাস বন্ধ থাকার পর গত ৯ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজবাহী প্রথম ট্রেন বাংলাদেশ আসে৷
বাংলাদেশে শুক্রবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪০-৪৫ এবং প্রতি কেজি বিদেশি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়৷ এক মাস আগের তুলনায় দেশি পেঁয়াজের দাম ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং বিদেশি পেয়াজের দাম ১৫ শতাংশ কমেছে৷
ভারত থেকে আমদানি অব্যাহত থাকলে দাম আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা কৃষক এবং আড়তদারদের৷
পাবনার বেড়া থানার নলভাঙ্গা গ্রামের পেঁয়াজ চাষি আব্দুস সালাম টেলিফোনে ডয়চে ভেলকে বলেন, ‘‘বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে৷ এখন প্রতিমণ ১৪০০/১৫০০ টাকায় বিক্রি করছি৷ দাম আরো কমে গেলে লাভ আর থাকবে না৷ উৎপাদন খরচ উঠা নিয়েই তখন কষ্ট হবে৷
‘‘এ বছর আমি ১০০ শতক জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছি৷ আমাদের এলাকার প্রায় ৯৮ শতাংশ জমিতেই পেঁয়াজ আবাদ হয়৷ ভারত থেকে আমদানি বন্ধ না হলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বে৷ কৃষকদের বাঁচাতে সরকার যদি আমদানি বন্ধ করতেন তবে আমরা বাঁচতাম৷’’
শরীয়তপুরে এ বছর ৩ হাজার ৩শ ৩৩ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে৷ আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়েছে৷
জেলার জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের কৃষক রবিন মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, এ বছর ৩ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম৷ গত দুই বছর লোকসান হলেও এ বছর উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ৩০ হাজার টাকার উপরে লাভ হয়েছে৷
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল হক বলেন, ‘‘সরকার যদি প্রতিটি এলাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতো এবং ফসল উৎপাদনে সহজ শর্তে ঋণ দিতো তাহলে আমরা গরিব কৃষকরা আরেকটু লাভবান হতাম৷
‘‘আমরা এত কষ্ট করে আবাদ করে কেজিতে ৭-৮ টাকা লাভ করি৷ অথচ আড়তদাররা আমাদের থেকে পেঁয়াজ কিনে নিয়ে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা করে লাভ করে৷’’
শ্যামবাজারের আড়তদার শামসুর রহমান অবশ্য উল্টো কৃষকদের বিরুদ্ধে পেঁয়াজ মজুদ করে রাখার অভিযোগ তোলেন৷
তিনি বলেন, ‘‘এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় মাঠে পেঁয়াজ নষ্ট হয়নি৷ কৃষকদের ফসল সংরক্ষণেও সুবিধা হয়েছে৷ গত বছরের শেষ দিকে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল৷ সেই আশায় এখন কৃষকরা পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছেন না৷ অথচ পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো হয়েছে৷ বাজার সামাল দিতে সরকার পেঁয়াজ আমদানি করছে৷
‘‘আমরা আড়তদার৷ আমরা যত বিক্রি করবো তত লাভ হবে৷ দেশি উৎপাদন হোক বা বিদেশ থেকে আমদানি করা, তাতে খুব একটা পার্থক্য হয় না৷ আমাদের লাভ পণ্য বিক্রির পরিমাণের উপর৷ তবে একজন নাগরিক হিসেবে আমি বলবো পেঁয়াজ আমদানি না করাই ভালো৷ তাতে পরনির্ভরশীলতাও কমবে৷ গতবার ভারত নিজেদের সুবিধার জন্য পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে আগুন ধরে গিয়েছিল৷ সরকার তখন কৃষকদের বেশি আবাদ করতে বলেছেলি৷ কৃষকরা সে অনুযায়ী আবাদ করেছে৷ এখন যদি ফসলের ন্যায্য দাম না পায় তবে তাঁরা নিরুৎসাহিত হবে৷ কৃষকদের উৎসাহ না দিলে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে না৷’’
কৃষকদেরও বেশি লাভের আশায় পেঁয়াজ মজুদ না করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘না হলে পরে তাদের অনেক লোকসান হবে৷ কারণ, ভারতেও এবার পেঁয়াজের আবাদ ভালো হয়েছে৷’’
শ্যামবাজার আড়তে শুক্রবার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৮/৩৯ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ২৮/২৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি৷
গত বছর পেঁয়াজ নিয়ে সংকটকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও একাধিকবার কৃষককে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘‘তিন বছরের মধ্যে সরকার পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চায়৷ এ জন্য মৌসুমের সময় আমদানি নিয়ন্ত্রণের চিন্তা রয়েছে সরকারের৷’’
২০১৮ সালে পেঁয়াজ রপ্তানি করে শীর্ষ আয় করা দেশের তালিকা: