প্রতারণায় ভরা চাকরির বাজার
২৫ মে ২০১৬ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে অফিস সহকারী পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়৷ চাকরি প্রত্যাশী অনেকেই আবেদন করেন৷ আবুল কালাম নামে একজন অন্যদের সঙ্গে এই পদে চাকরি পেতে পরীক্ষাও দেন৷ এ সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত দুই সেনাসদস্য৷ তিন লাখ টাকা দিলে তার চাকরি হবে বলে জানানো হয়৷ অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য হওয়ায় কালাম তাঁকে বিশ্বাস করেন৷ জমি বিক্রি করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের হাতে ওই টাকা তুলে দেন৷ এরপর তাঁকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়৷ চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে তিনি দেখেন তার নিয়োগপত্রটি ভুয়া৷ গরিব পরিবারের সন্তান কালামের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ে৷
কী করবেন বুঝতে না পেরে দ্রুত ছুটে যান ব়্যাব অফিসে৷ ব়্যাব বিষয়টির তদন্ত করতে গিয়ে দেখে শুধু কালাম নয়, এমন ১৩ জনের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা করে মোট ৩৯ লাখ টাকা নিয়েছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আবুল কাশেম (৫২), নাসির উদ্দীন (৪৬) ও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য তারেক হাসানসহ ৫ জন৷ গত ২৯ এপ্রিল ওই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ব়্যাব৷
ব়্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘‘ভুক্তভোগীরা নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে গেলে জানতে পারে তাদের নিয়োগপত্র ভুয়া৷ এই চক্র তখন ভুক্তভোগীদের নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে৷ এমনকি বিষয়টি গোপন রাখতে ‘গুম' করার হুমকিও দেয় তারা৷'' ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই পরে পাঁচজনকে আটক করা হয়৷
সর্বশেষ গত ৬ মে সেনাবাহিনী ও বিজিবিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় দুই জনকে গ্রেপ্তার করেছে ব়্যাব৷ গ্রেপ্তারকৃতরা চাকরি প্রার্থীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিভিন্ন গোপনীয় স্থানে নিয়ে প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা ও মেডিক্যাল চেকআপ সম্পন্ন করে নিয়োগপত্র দেয়৷ ওই নিয়োগপত্র নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করতে গিয়ে তারা বিপাকে পড়েন৷ পরে ব়্যাব প্রতারকদের গ্রেপ্তার করে৷ শুধু এই দু'টি ঘটনা নয়, প্রতিনিয়তই সাধারণ চাকরি প্রত্যাশীরা এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন৷
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান – এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আহসান উল্লাহ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকায় বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন৷ তবে ব্যাংকিং ব্যাবস্থায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার পর পরীক্ষা নেয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগ৷ এরপর তারা আমাদের কাছে একটি তালিকা দিলে সে অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়৷ এখানে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ কিন্তু সব সেক্টরে তো আর এ ধরনের ব্যবস্থাপনা নেই৷ ফলে অনেকক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে৷''
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোও চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য পৃথক বিভাগ খুলেছে৷ সপ্তাহে একদিন চাকরির তথ্য ও এ সংক্রান্ত প্রস্তুতির খবরাখবর নিয়ে দুই থেকে চার পাতা ছাপা হচ্ছে৷ সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির খোঁজ খবর ও কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখা করা হচ্ছে৷ তারপরও সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে দিক নির্দেশনা না আসায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন৷ কে কোন দিকে চাকরির জন্য ছুঁটবেন, তার কোনো নির্দেশনা নেই৷
দৈনিক সমকালে ‘চাকরি নিয়ে' নামে সপ্তাহে একদিন দুই পাতার ক্রোড়পত্র বের হচ্ছে৷ এই পাতাটির সম্পাদনা করেন সিনিয়র সহ-সম্পাদক রুদ্র আরিফ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সরকারের তরফ থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরাই চাকরি প্রত্যাশীদের একটা দিক নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করি৷ দিন দিন আমাদের এই বিভাগ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ চাকরি প্রত্যাশীদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই সামনে আমরা এটা ট্যাবলয়েড আকারে চার পাতার আয়োজন করতে যাচ্ছি৷ শুধু তাই নয়, আমরা যে প্রধান শিরোনামটি করব, সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানের একটা সাক্ষাত্কারও থাকবে৷ তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানে কিভাবে পরীক্ষা দিতে হবে তার একটা নির্দেশনা পাবেন শিক্ষার্থীরা৷ আসলে আমাদের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের চাকরি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়া৷''
বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি)৷ সরকারি কোনো দপ্তর থেকে কোনো পোস্ট খালি হওয়ার তথ্য জানানো হয় পিএসসিকে৷ এরপর পিএসসি সার্কুলার দেয়৷ তারা কয়েক ধাপে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইবা নিয়ে নিয়োগ দিয়ে থাকে৷ তবে এই দফতর থেকে চাকরি প্রত্যাশীদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয় না৷ ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়েই পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের আর ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা নিতে গিয়েই প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে৷
‘এইচআর কাইটস' নামে একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী চাকরি প্রত্যাশীদের বাছাই করে থাকে৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সাউদ বিন মাসউদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে আমার হাতে বাছাই করা ৪ লাখ বায়োডাটা রয়েছে৷ বাংলাদেশের বহু প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে তাদের চাহিদা পাঠিয়ে থাকে৷ আমরা সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিয়ে তাদের কর্মী পাঠিয়ে থাকি৷ আমরা কোনো কর্মীর কাছ থেকে অর্থ নেই না৷ যারা আমাদের চাহিদা দেয় তাদের কাছ থেকে একটা কমিশন নেই৷'' তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশে এখন মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় খোলার সময় এসেছে৷ যেখানে চাকরি প্রত্যাশীরা তাদের বায়োডাটা দিয়ে রাখবে৷ সেখান থেকে যার যে লাইন সে অনুযায়ী সেইসব জায়গায় পাঠানো হবে৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷