নির্যাতন ও প্রতারণার শিকার প্রবাসী শ্রমিক
২৩ ডিসেম্বর ২০১৮হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড়শ' জন শ্রমিক ফিরছেন৷ কোনো কোনো দিন এই ফিরে আসা নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা দুইশ' ছাড়িয়ে যায়৷
২০১৭ সালের শেষের দিকে সৌদি শ্রমমন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক বিবৃতিতে দেখা যায়, সে দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকার ১২ টি সেক্টরকে ‘সৌদিকরণ' করার ঘোষণা দিয়েছে৷ এর ফলে গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ২০০ জন প্রবাসী শ্রমিক সে দেশ ছেড়েছে৷ সৌদি সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই গিয়েছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার৷ এছাড়া গত তিন মাসে সৌদি আরব থেকে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন শ্রমিক শ্রমবাজার ত্যাগ করেছে৷ তবে এর মধ্যে কী পরিমাণ বাংলাদেশি আছেন, তা জানা সম্ভব হয়নি৷
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭-২০১৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে গমনের হার প্রায় অর্ধেক হয়েছে৷ ৭ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে সৌদি আরবে শ্রমবাজার চালু হলে ২০১৬-তে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৩ জন শ্রমিক, ২০১৭ সালে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ শ্রমিক দেশটিতে যায়৷ ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ লাখ ৬ হাজার ৭৬৮ জন সৌদি আরব গেছেন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক৷
২০০৮ সালে এ যাবত কালের সর্বোচ্চ ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন কর্মী আরব আমিরাতে গেলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে সেটি ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ নেমে আসে৷
যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েত থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রথম দেশে ফিরতে বাধ্য হয় ১৯৯০ সালে ইরাকের আগ্রাসনের সময়ে৷ তবে ২০১৪ সালের শেষ দিকে আবারও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী গিয়েছে দেশটিতে৷
প্রতি বছর ফিরছে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক
কেন শ্রমিক ফিরছেন জানতে চাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি ওকাপ-এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘ফিরছে বেশ কয়েকটি কারণেই৷ বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কথা যদি আমি বলি, তাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরছেন৷ অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই আমাদের শ্রমিকরা আনডকুমেন্টেড, তথা বৈধ অনুমতি ও কাগজসহ যায়নি৷ তাঁদেরকে ধরপাকড় করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে এটা বেশি ঘটছে৷ ফ্রি ভিসার নামে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে গিয়ে তাঁরা কাজ করার অনুমতি পায় না , পুলিশ গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়৷''
ফ্রি ভিসা প্রসঙ্গে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, ‘‘আসলে এমন ভিসা নেই৷''
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব থেকে প্রায় ৭ হাজার মেয়ে ফেরত এসেছে৷ চলতি বছরই এসেছে দেড় হাজারের বেশি নারী শ্রমিক৷
‘‘১৯৭৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার তৈরি হওয়ার পর থেকে কত লোক বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন সেটির হিসাব আমাদের কাছে আছে৷ কিন্তু কত লোক ফেরত এসেছেন, সেরকম কোনো ডাটা আমরা কোথাও পাই না৷ যেহেতু তাঁরা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার হয়েই আসে, তাই ফিরে আসার সংখাটা হিসাব করা কঠিন কিছু নয়'' বলেই মনে করেন শরীফুল হাসান৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে গত এক বছরে প্রায় ৫০ হাজার লোক ফেরত এসেছেন আন ডকুমেন্টেড বা কাগজ না থাকার কারণে৷ গত কয়েক বছরে দু লাখের বেশি শ্রমিক ফেরত এসেছে৷ আর শুধু যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরছে, তা নয়, মালোয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকেও শ্রমিক ফেরত এসেছে৷ এমনকি আনডকুমেন্টেড প্রচুর বাংলাদেশিকে ইউরোপও ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ জার্মানি থেকেও ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের৷''
ফেরত আসাদের জন্য নেই পুনর্বাসন
ফিরে আসা ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ কী? শরীফুল হাসান বলেন, ‘‘যখন দেশ থেকে কেউ বিদেশ যান, তখন আমরা তাঁকে ধার দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকি৷ কিন্তু লোকটি বা নারীটি যখন ফেরত আসেন তখন তাঁকে সমাজের চোখে অপরাধী বানিয়ে ফেলি বা ব্যর্থ ঘোষণা করি৷ প্রত্যেকে এমনভাবে তাকায় যেন সে অপরাধ করেছে৷ অথচ এই ফেরত আসায় হয়তো তার কোনো ভূমিকা থাকে না৷ রাষ্ট্র যাওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাসী শ্রমিককে যে রিকগনিশন (স্বীকৃতি) দেয়, সেটি ফিরলে পায় না৷''
ফেরত আসা লোকদের পুনর্বাসনে রাষ্ট্রীয় কোনো কাঠামো বা পদ্ধতি নেই৷ ফেরত আসা লোকজন যে শুধু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে, এমনটি নয়৷ সফল অনেকেও ফেরেন ১০/১৫ লাখ টাকা নিয়ে৷ সেই টাকা নিয়ে তিনি কী করবেন সে বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি৷
ফেরত আসাদের প্রসঙ্গে একই তথ্য জানালেন শাকিরুল ইসলাম৷ রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো পুনর্বাসন প্রকল্প বা উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে ওকাপ নিজস্ব উদ্যোগে ফিরে আসা শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিক, যাঁদের (শারীরিক ও মানসিকভাবে) চরম বিপযস্ত থাকে, তাঁদের প্রাথমিক আশ্রয় থেকে আইনি সহায়তা পর্যন্ত দেয়৷ যেসব নারী একেবারেই আর বাড়ি ফিরতে পারেন না, তাঁদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে দুটি গার্মেন্টস পরিচালনা করছে সংস্থাটি৷ পুনর্বাসন, মানসিক কাউন্সেলিংয়ের মতো সহায়তাগুলো ব্র্যাকও দিয়ে আসছে বলে জানান শরীফুল হাসান৷
শ্রমবাজার প্রসারিত করতে হবে
শ্রমবাজার প্রসারিত করার কোনো বিকল্প নেই৷ গত ৪৭ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের ৮টি দেশ ও মালোয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক বাংলাদেশের শ্রমবাজার চলছে৷ এসব দেশের কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলেই শ্রমবাজারে ধস নামে, যেমনটি ঘটেছে সৌদি আরবের কর্মক্ষেত্র সংকোচনের ক্ষেত্রে৷ এক্ষেত্রে বিশেষ বিষয় ধরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে ইউরোপের বাজারগুলোতে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিলেন শরীফুল হাসান৷
শাকিরুল ইসলাম বললেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে, সেসব দেশের চুক্তিগুলো আরো স্পষ্ট ও জোরালো করা উচিত৷ এখানে চুক্তির ঘাটতিগুলোর দিকে অধিক নজর দিতে হবে৷