1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সৌদি ফেরত নারী কর্মীদের কান্না

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৩ মে ২০১৮

সৌদি আরব থেকে তিন দিনে ৯৩ জন নারী শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরেছেন৷ শনিবার রাতেই ফিরেছেন ৬৬ জন৷ সাংবাদিকদের কাছে সেখানকার নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা৷ এই নিয়ে গত তিন বছরে পাঁচ হাজার নারী দেশে ফিরে এলেন৷

https://p.dw.com/p/2y9q3
সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা এক বাংলাদেশি নারীছবি: bdnews24

গত বছরের আগস্ট মাসে সৌদি আরবে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ ঐ ভিডিওটিকে নিয়ে তখন অনেক সংবাদমাধ্যম খবর পরিবেশন করে এবং শেষ পর্যন্ত নির্যাতনের সত্যতাও পাওয়া যায়৷

নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার পথে রিয়াদ বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে বসে এক আরবকে ঐ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই নারী, যা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছেড়ে দেন সেই ব্যক্তি৷ ভিডিওতে ঐ নারীর এক হাতে ক্ষতচিহ্ন, আরেক হাতে গোটা গোটা ফোস্কা দেখা যায়৷ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সৌদি আরবে কাজে আসার পর প্রতিদিন আমাকে ছয় থেকে সাতবার গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো৷ সেই থেকেই হাতে ফোস্কা হয়ে গেছে৷’’ ভিসা ও পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, নির্যাতিত ঐ বাংলাদেশি নারীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়৷ তিনি গত বছরের ২২ জানুয়ারি সৌদি আরবে যান৷ সৌদিতে তাঁর নিয়োগকর্তা ছিলেন আজিজা নাশহাত মোহাম্মদ আলী কাকা৷

গত শনিবার (১৯ মে) রাত ৯টায় এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে করে বাংলাদেশে ফিরে আসা ৬৬ জন নারীর একজন হলেন সালমা ( ছদ্ম নাম)৷ তিনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, ‘‘সৌদি আরবে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ সেখানে তাঁদের আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার পাশাপাশি রড গরম করে ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হয়৷’’ সালমা বলেন, ‘‘আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে মালিক৷ আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসি৷ দূতাবাস থেকে আমাকে আউটপাস দিয়ে দেশে পাঠায়৷ আমি এক বছর কাজ করেছি৷ কিন্তু বেতন দিয়েছে তিন মাসের৷ তার ওপর আমাকে ওরা গালাগালি করতো, খেতেও দিত না ঠিকমতো৷’’

সৌদি আরব জানে, বাংলাদেশের পক্ষে এর প্রতিকার দাবি করা সম্ভব নয়: শরিফুল হাসান

লাবনী (ছদ্ম নাম) নামে আরেকজন জানান, ‘‘সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মিরাজ নামের এক দালালকে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম৷ সে আমাকে বলেছিল, সৌদি আরব অনেক ভালো জায়গা৷ কিন্তু যাওয়ার পর প্রথমে আমাকে এক মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়৷ মালিকের অত্যাচারে ঐ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই৷ তখন আমারে ধরে একটা কোম্পানির মাধ্যমে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়৷ আমার মতো আরও কয়েকশ' মেয়ে আছে সেখানে৷ তাদের দিয়ে জোর করে দেহব্যবসা করানো হয়৷ আমি একবার সুযোগ বুঝে আমার স্বামীকে ফোন করে সব বলি৷ তারপর আমাকে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়৷’’

‘ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম’-এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রতি মাসে গড়ে ২০০ করে নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন৷ সৌদি আরবের রিয়াদ এবং জেদ্দায় সেফ হোমগুলোতে গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন৷ ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে জানান, গত তিন বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন৷ এই নারীদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার৷’’

তিনি বলেন, ‘‘২০১১ সালে ফিলিপাইন্স ও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়৷ তার প্রধান কারণ ছিল নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন৷ ফিলিপাইন্সের একটি প্রতিনিধি দল সৌদি আরবে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে নির্যাতনের প্রমাণ পেয়ে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়৷ ২০০৮ সাল থেকে সৌদি শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ ছিল৷ সে কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠাতে রাজি হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশ তখন ভাবেনি যে অন্যরা যখন সৌদি আরবে নির্যাতনের কারণে নারী শ্রমিক পঠানো বন্ধ করেছে, আমরা কেন পাঠাচ্ছি৷ নির্যাতন যাতে না হয় সেরকম কোনো পদক্ষেপের কথাও বলেনি বাংলাদেশ৷’’

আইনগত প্রতিকার পেতে হলে এখানকার থানায় মামলা করতে হয়: দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর

তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে যৌন নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীও আছেন৷ এছাড়া শারীরিক নির্যাতরে শিকার হয়েছেন অনেকেই৷ আরেকজন মেয়েকে আমরা পেয়েছি যে সৌদি আরবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন৷ এখন তাঁর বাবা তাঁকে আর পরিবারে ফেরত নিতে রাজি নন৷ আমরা বাধ্য হয়ে তাঁকে শেল্টার হোমে পাঠিয়েছি৷ সৌদি আরব জানে, বাংলাদেশের পক্ষে এর প্রতিকার দাবি করা সম্ভব নয়৷ ফলে নির্যাতনও বন্ধ হয় না৷’’

২০১৫ সাল থেকে ২ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয় সৌদি আরবে৷ তাঁদের মধ্যে নির্যাতনসহ নানা করণে ৪০ হাজারের মতো নারী শ্রমিক সেখান থেকে ফেরত এসেছেন৷

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর সারোয়ার আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রিয়াদ এবং জেদ্দায় আমাদের দু'টি ‘সেফ হোম’ আছে৷ যেসব নারী কর্মী বিপদে পড়েন, তাঁদের আমরা সেখানে আশ্রয় দেই৷ এরপর তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি৷ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি৷ এখানো সেখানে ৪০ জনের মতো নারী কর্মী আছেন৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা নির্যাতনের অভিযোগ পাই৷ এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও আছে৷ আইনগত প্রতিকার পেতে হলে এখানকার থানায় মামলা করতে হয়৷ তবে সেই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেই শ্রমিককে এখানে থাকতে হয়৷ কিন্তু প্রায় কেউ-ই শেষ পর্যন্ত মামলা করতে চান না৷ থাকতেও চান না৷ তবে শুধু নির্যাতন না, অনেকে এখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারেন না৷ ভাষাগত সমস্যা হয়৷ আবার অনেকের কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়৷ এ সব কারণেও ফেরত যান৷’’

সারোয়ার আলমের কথায়, ‘‘আমরা তারপরও এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি৷ কথা বলছি৷ কিন্তু জনবল কম৷ আমাকে একা ৫৩টি জেলা দেখতে হয়৷’’

সরকার চাইলে নিয়োগ কর্তাদের চিহ্নিত করে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ করতে পারে: শামীম আহমেদ চৌধুরী

তিনি জানান, ‘‘সৌদি আরবে আইন বেশ কড়া৷ অর্থাৎ ঘটনা প্রমাণ করতে পারলে প্রতিকার পাওয়া যায়৷ আমরা ২-৩টি ঘটনায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত যেতে পেরেছি৷ অন্যগুলোয় পারিনি৷ কারণ কেউ থেকে মামলা চালাতে চায় না৷ তবে চাইলে আমরা সহযোগিতা করি৷’’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী কর্মী সৌদি আরব যান, তাঁদের কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না৷ তাই কোনো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তাঁরা মামলা না করে নিজের পাওনা নিয়ে দেশে ফেরত আসতে চান৷ দেশে ফেরত আসলে তাঁকে লিখিত দিতে হয় যে নিয়োগ কর্তা তাঁর সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ বা শর্ত ভঙ্গ করেনি৷ ফলে আইনগত প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়৷ কিন্তু সরকার চাইলে ঐ নিয়োগ কর্তাদের চিহ্নিত করে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ করতে পারে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছি কীভাবে সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়৷’’

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর পদ্ধতিতেই গলদ আছে৷ এমওইউ স্বাক্ষরের মাধ্যমে সেখানে নারী শ্রমিক পাঠানো হয়৷ ফলে কোনো সরকারেরই আইনগতভাবে দায় নাই৷ দায় হলো শুধুমাত্র নিয়োগ কর্তার৷ যদি দুই সরকারের মধ্যে চুক্তির অধীনে এই শ্রমিকদের পাঠানো হতো, তাহলে আইনি প্রতিকার পাওয়া যেত৷ তাই এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা দরকার৷ তা না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে৷’’

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

২০১৬ সালের ২ মে’র ছবিঘরটি দেখুন...