1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘প্রতিশোধ নিতে ধর্ষণকে বেছে নেয়’

২ এপ্রিল ২০১৯

আবারও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ এবার উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে৷ পুলিশ বলছে, তাঁরা ধর্ষকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুবর্ণচরে বারবার কেন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে?

https://p.dw.com/p/3G6hY
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/dpa/Keystone USA Falkenberg

৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ওইদিন দিবাগত রাতে আওয়ামী লীগ নেতা রহুল আমিনের নির্দেশে এক গৃহবধুকে তাঁর স্ত্রী সন্তানকে বেঁধে রেখে তাদের সামনেই সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে দুর্বত্তরা৷ শুরুতে ওই ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে এবং আসামিদের আটকে নানা টালবাহানা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাপক সমালোচনার মুখে তৎপর হয়৷ রহুল আমিনসহ আসামিরা এখন কারাগারে আছেন৷ সম্প্রতি রহুল আমিনের জামিন হলেও তা বাতিল হওয়ায় সে কারাগার থেকে বের হতে পারেনি৷ তবে মামলায় এখনো চার্জশিট দেয়া হয়নি৷

‘যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আমার লোক নয়’

তিন মাসের মাথায় আবারও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

তিন মাসের মাথায় রবিবার উপজেলা নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় ওই এলাকায় আরো একজন গৃহবধু, ছয় সন্তানের মা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অভিযোগ, ওই দিন উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সমর্থকরা তাঁকে ধর্ষণ করে৷ 

ওই নারী সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘সুবর্ণচর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনি ও তাঁর স্বামী চশমা প্রতীকের প্রার্থী তাজউদ্দিন বাবরকে ভোট দেন৷ এতে প্রতিপক্ষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ফরহাদ হোসেন বাহারের (তালা প্রতীক) লোকজন ক্ষুব্ধ হয়৷ নির্বাচনে বাহার জয়ী হন৷ সন্ধ্যায় আমি ও আমার স্বামী মোটর সাইকেলে করে উত্তর বাগ্যা গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে তালা প্রতীকের প্রার্থী নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহারের সমর্থক ইউসুফ মাঝির নেতৃত্বে ১০-১২ জন আমাদের মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে মারধর করে৷ পরে তাদের উত্তর বাগ্যা গ্রামের রহুল আমিনের (আগের ধর্ষণের মূল হোতা) মৎস্য খামারে নিয়ে যায়৷ সেখান থেকে আমাকে খামারের পাশে কলাবাগানে নিয়ে বেচু মাঝি, বজলু ও আবুল বাসার মারধর ও ধর্ষণ করে৷ এ সময় আমার স্বামীর চিৎকারে লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করে৷''

রাতেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তাঁর স্বামী বাদী হয়ে মোট আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷ পুলিশ ইউসুফ মাঝি ও আবুল বাশার নামে দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷

‘দুর্বৃত্তরা নবনির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বাহারের লোক’

এখনো হুমকির মুখে পরিবার

ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘দুর্বৃত্তরা নবনির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বাহারের লোক৷ বাহার আওয়ামী লীগ করেন৷ তবে মূল হোতা বিচু মাঝি৷ সে ইউসুফ মাঝির ভাই৷ ইউসুফ মাঝিসহ দুইজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ এর আগে বিএনপি করলেও এখন আওয়ামী লীগ করে৷ তারা আসলে সুবিধাবাদী৷'' 

তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আগে বিচু মাঝির সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে সামান্য পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিলো৷ তবে ভোটের দিন ভোট দেয়া নিয়ে তর্কাতর্কি হয়৷ তার জেরেই আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা৷''

ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী অভিযোগ করেন, ‘‘পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে দেরি করে৷ আগেই তৎপর হলে সবাইকে গ্রেপ্তার করা যেত৷ এখন বিচু মাঝি ও তার লোকজন আমার ছেলেমেয়ে এবং আমাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে৷ আর পুলিশও আলামত সংগ্রহ ও পরীক্ষার নামে সময় পার করছে৷ আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি৷''

সুবর্ণচর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবং এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম খলিল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা অভিযোগ পাওয়ার পরই ঘটনাস্থলে গিয়েছি৷ দুই জনকে গ্রেপ্তার করেছি৷ মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ করে আরো অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে৷''

তিনি জানান, ‘‘আসামিদের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের পূর্ব বিরোধ ছিল৷ তবে ভোটের দিন ভোট দেয়া নিয়ে ঝামেলা হয়৷ তারই জেরে এই ঘটনা৷'' 

‘এখানে ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় আছে’

সুবর্ণচরের নবনির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহার ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘আমি ধর্ষণের ঘটনা শোনার পর ওই এলাকায় গিয়েছি৷ যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আমার লোক নয়, আমি তাদের চিনিওনা৷ তাদের কাছ থেকে এককাপ চাও খাইনি কখনো৷ আমিও এই ধর্ষণের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের উপজেলায় চেয়ারম্যান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন৷ ভোট হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান পদে৷ আমরা তিনজন প্রার্থী ছিলাম, সবাই আওয়ামী লীগের৷ আমি উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি, এখন আওয়ামী লীগ করি৷''

কেন সুবর্ণচরে বার বার সংঘবদ্ধ ধর্ষণ?

নবনির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহার বলেন, ‘‘এই সুবর্ণচরে ভোটের আগে, ভোটের রাতে, ভোটের পরে আরও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷ আমারও প্রশ্ন কেন এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে৷ এর কারণ কী? এটা আমারও প্রশ্ন৷ আমি পুলিশকে বলছি এটা দেখতে৷ সাংবাদিকরাও এটা নিয়ে কাজ করলে ভালো হয়৷''

ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. ইব্রাহিম খলিল খলিল বলেন, ‘‘চর এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব আছে৷ তাদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে ও রাজনৈতিক বিরোধ আছে৷ এইসব বিরোধে প্রতিশোধ নিতে তারা ধর্ষণের পথ বেছে নেয়৷ প্রতিপক্ষের নারীদের টার্গেট করে৷ এর মাধ্যমে তারা ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করে৷ অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানকার খবর আমরা দেরিতে পাই৷'' 

‘আমরা অভিযোগ পাওয়ার পরই ঘটনাস্থলে গিয়েছি’

তবে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন, রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যখন নারীকে ধর্ষণ করা হয় তখন এটা ভয়াবহ ব্যাপার৷ এখানে ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় আছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘সুবর্ণচরে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের রাতে যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে সেখানে পুলিশের ভূমিকা গ্রহণযোগ্য ছিলনা৷ মূল আসামিকে তারা বাদ দিয়েছিল৷ এর একটা প্রভাব আছে৷ প্রতিবাদের মুখে পুলিশ এই মামলায় হয়তো পরে সঠিক পথে গেছে৷ কিন্তু আগে আরো অনেক ঘটনা হয়তো ঘটেছে, যা আমরা জানিই না৷ ফলে সুবর্ণচরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ আবারো সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘শুধু সুবর্ণচর নয়, সারাদেশেই নারীরা ক্ষমতার কাছে ভালনারেবল৷ তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন বা তাদেরকে ধর্ষণ করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়৷''