ভুয়া খবরের শিকার হলে প্রতিকার?
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ডয়চে ভেলে : ভুয়া সংবাদ বিষয়টা কি?
শামীম রেজা : আমরা তো আসলে ‘ভুয়া সংবাদ' নামে সংবাদের কোনো ক্যাটাগরি আগে শুনিনি৷ একটা ছিল ‘হলুদ সাংবাদিকতা'৷ যেটা সংবাদ না আপনি সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করতেন৷ বা এমন সংবাদ যেটা বাস্তবে নেই, আরেকজনের জন্য মানহানিকর৷ এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আমরা একসময় পরিচিত ছিলাম৷ এখন ‘ভুয়া সংবাদ' বিষয়টা অনানুষ্ঠানিকভাবে মাঝে মধ্যে শোনা যায়৷ ‘ভুয়া সংবাদ' আমি যেভাবে বুঝি- যেটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই৷
হলুদ সাংবাদিকতা ও ভুয়া সংবাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা কি?
এই দু'টোর মধ্যে যতটুকু না পার্থক্য তার চেয়ে মিলটাই বেশি৷ হলুদ সাংবাদিকতায় সেই বিষয়টাই তো ছিল৷ যেটা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আপনি লিখলেন, আসলে সেটার কোনো ভিত্তি নেই৷ বা অতিরঞ্জনভাবে লিখছেন৷ আমি যদি বুঝে থাকি, ভুয়া সংবাদ হলো আসলে কোনো সংবাদ হয় না, কিন্তু আমি একটা সংবাদ বানালাম৷ সুতারাং দু'টোর মধ্যে যতটুকু না পার্থক্য, তার চেয়ে মিল কিন্তু বেশি৷
বাংলাদেশে এই ধরনের সাংবাদিকতা এখন কোন পর্যায়ে আছে?
এটা তো আসলে পরিমাপ করা কঠিন৷ আপনি যদি আমাকে বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কোন পর্যায়ে আছে, বা বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্ট কোন পর্যায়ে আছে, তাহলে আমি একটা বিশ্লেষণ আপনাকে বলতে পারব৷ কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতা বা ভুয়া সংবাদ পর্যবেক্ষণ করা বা এটার মূল্যায়ন করা খুব কঠিন কাজ৷
আমাদের সমাজে এই ধরনের সংবাদের প্রভাব কেমন?
নিশ্চয়ই এর একটা প্রভাব দেখা দিয়েছে, না হলে তো আর আমরা এই আলোচনা করতাম না৷ সেটার প্রভাব তো নিশ্চয়ই ইতিবাচক নয়৷ সংবাদকর্মী হতে গেলে তার যে দায়-দায়িত্ব রয়েছে, সংবাদ প্রকাশ করতে গেলে যে দায়-দায়িত্ব নিয়ে করতে হয়, এখন আপনি যদি তার উল্টোটা করেন, তাহলে নিশ্চয়ই সমাজে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ হলুদ সাংবাদিকতাকে আমি সাংবাদিকতা বলতে চাই না৷
সেই ধরনের সংবাদে যদি একজন ব্যক্তির মানহানি ঘটে, যেটা ঘটনা নয়, আপনি সেটা লেখেন, তাহলে পাঠকদের মধ্যে একটা অংশ সেটা বিশ্বাস করলেও করতে পারে৷ তাতে তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিনতি খারাপের দিকে যেতে পারে৷ সংবাদের উদ্দেশ্যই ছিল জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা আনা৷ আপনি যদি সেটার উল্টোটা করেন, তাহলে আপনি জবাবদিহিতার জায়গায় যাচ্ছেন না৷ আপনি যে সংবাদটি প্রকাশ করলেন, সেটি ব্যক্তি হোক, প্রতিষ্ঠান হোক বা কোনো মহল নিয়ে হোক, এর একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই৷ এভাবে তো সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে৷
এই ধরনের সংবাদে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা কী প্রতিকার পান? আর আমাদের দেশে প্রতিকারের কী ব্যবস্থা আছে?
আমাদের দেশে আইন আছে৷ এমনকি মৌখিকভাবেও আপনি যদি কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন, তার জন্যও আইন আছে৷ কিন্তু বাস্তবে যেটা ঘটে, এই আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়াটা তো একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ একজন ব্যক্তি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তিনি যদি প্রভাবশালী হন, তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন, মামলা করতে পারেন৷ অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সেটা করেন৷ এটা যদি গ্রামে-গঞ্জে হয়, আমাদের অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি, তাতে তাঁরা আদালতে শরণাপন্ন হন না৷ অনেক সময় সম্ভব হয় না৷ এক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ক্ষতিগ্রস্তই থেকে যাচ্ছে৷
আমাদের যে আইন আছে ,সেটা কতটা সময়োপযোগী বা সেখানে কী ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে?
আমাদের বিদ্যমান আইনে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে৷ এটা সংবাদপত্র হলে আপনি প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন৷ সেখানে কোনো আপস বা সালিশের ব্যবস্থা হতে পারে৷ এখানে যার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে একটা সালিশ হতে পারে, যেটা করতে পারে প্রেস কাউন্সিল৷ তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন৷ আপনি জানেন যে, সম্প্রতি এই ধরনের ঘটনায় একটা উন্নতি হয়েছে৷ সেটা সংবাদিকদের জন্য ভালো হয়েছে৷ যে কেউ এই ধরনের মামলা করলেই তাকে গ্রেফতার করা যাবে না৷ তাকে হাজির হতে বলা হবে৷ তবে এই আইনগুলো যখন করা হয়েছে তখন অনলাইন মিডিয়া ছিল না৷ তখন সামাজিক মাধ্যমগুলো ছিল না৷ সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এই বিধানগুলো করা হয়েছিল৷ উপনিবেশিক আমল থেকে এখন পর্যন্ত যে এই আইনগুলোর খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়৷ বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই আইনগুলো মোটামুটি একই ধরনের৷
এটা তো গেল আইন৷ আরেকটা দিক হলো, গণমাধ্যম কী করবে? কোন তথ্য সংগ্রহের পর ভুল হতে পারে, সেটা রিপোর্ট আকারে ছাপা হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকার চাইলে সংবাদপত্রকে ক্ষমা চাইতে হবে, সংশোধনী ছাপতে হবে৷ যে জায়গায় খবর ছাপা হয়েছে, ঠিক সেখানেই প্রতিবাদটা ছাপতে হবে৷ কিন্তু আমাদের দেশের সংবাদপত্রে কি সেটা হচ্ছে? খবরটা হয়ত প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবাদ ছাপা হচ্ছে ভেতরে, খুব ছোট করে৷
আমাদের কোন ধরনের সংবাদ মাধ্যমে এই ধরনের খবরের প্রবণতা বেশি দেখেন?
যেহেতু আমাদের অনেকগুলো সংবাদ মাধ্যম আছে এবং সেগুলো সবভাবেই বিকশিত হচ্ছে৷ আগে যখন শুধু সংবাদপত্র ছিল, আমাদের দৃষ্টি তখন শুধু সংবাদপত্রের দিকেই যেত৷ সংবাদপত্র এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, লিখে ফেলার গুরুত্ব তো অনেক বেশি৷ সংবাদপত্রেও ঘটতে দেখি, টেলিভিশনেও ঘটতে দেখি, তবে গাণিতিকভাবে তো বলা মুশকিল৷ এ ব্যাপারে আমাদের গবেষণাও নেই বললে চলে৷ পর্যবেক্ষণগুলো অত বিজ্ঞানভিত্তিক নয়৷ তবে এক ধরনের সমালোচনা আমরা বেশি দেখি অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে৷
ভুয়া সংবাদ আমাদের সাংবাদিকতাকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে?
নিঃসন্দেহে সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ সাংবাদিকতার যে নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে, সেটা তো তার সততা৷ যেটা সংবাদ নয়, সেটাকে যদি আপনি সংবাদ বানিয়ে ফেলেন, তাহলে তো পেশা হিসেবে এটার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকে না৷ এটা যে সত্যতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা তো আর টেকে না৷ ভুয়া সংবাদ আসলে কোনো সংবাদই নয়, এটাকে আপনি কোনোভাবেই সংবাদ বলতে পারেন না৷ মানহানিটা হলো- সংবাদের ভেতরে ভুল হতে পারে৷ আপনি অনিচ্ছাকৃতভাবেও ভুল করে থাকতে পারেন৷ ইচ্ছাকৃতভাবেও কেউ চেষ্টা করে থাকতে পারেন৷ সেটার পুরোটাই হয়ত অসত্য নয়৷ ভুয়া সংবাদের কোনো ভিত্তিই থাকে না৷ যেসব সাংবাদমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে টিকে আছে, এই ধরনের সংবাদে তারা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ পাঠকদের পক্ষে কোনটা সঠিক আর কোনটা সঠিক নয়, সেটার পার্থক্য করা সম্ভব নয়৷
এ থেকে বের হয়ে আসার পথটা কী?
আমার কাছে মনে হয় দু'টো বিষয়৷ একটা হলো প্রশিক্ষণ৷ আপনি যত বেশি প্রশিক্ষণ নেবেন, তত আপনার দক্ষতা বাড়বে৷ যিনি ভুয়া সংবাদ দিচ্ছেন, তিনি ইচ্ছে করে এটা দিচ্ছেন কি-না সেটা ভেবে দেখবার বিষয়৷ যিনি এই সংবাদটি দিচ্ছেন, তার আসলে সংবাদ লেখার দক্ষতা কতখানি? তিনি আসলেই এই সংবাদটা সঠিকভাবে লিখতে পারেন কি-না, সেটাও দেখার বিষয়৷ দক্ষতা যখন বাড়বে, তখন আমরা ধরেই নিই যে, তিনি আর ওই লাইনে যাবেন না৷ আরেকটা হলো, সাংবাদিক কে বা কাকে আপনি সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ৷ তার একটা স্বীকৃতির প্রয়োজন৷ তিনি যে গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন, ওই গণমাধ্যমের দায়িত্ব হবে তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা সময় পর কার্ড দেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া৷ এ ব্যাপারে একটু নিয়মতান্ত্রিক বা কঠোর হওয়া প্রয়োজন৷ আর একটা হলো, মানুষ যখন সচেতন হবে, সাংবাদিকতা নিয়ে ভাববে, এটা দেখবে, তখন এগুলো আর টিকবে না৷