‘প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কারে কমিশন করা যেতে পারে'
১৭ আগস্ট ২০২৪এ বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান।
ডয়চে ভেলে : সরকার পরিবর্তন হলে প্রশাসনসহ সব অফিসেই বিশৃংখলা দেখা দেয়। এর কারন কী?
আবু আলম শহীদ খান : প্রধান কারণ হলো তখন ডেমোক্র্যাসির বদলে মবক্র্যাসি কাজ শুরু করে। অনেকের অনেক ধরনের ক্ষোভ হতাশা তো আছেই। ব্যক্তি হিসেবে যখন সে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রান চায়, তখন সে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চায়। যখন অনেকজন একত্রিত হয়ে যায়, তখন তারা কোনো প্রক্রিয়া ফলো করতে চায় না। তারা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। সেটাই এর প্রধান কারণ।
সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা তো কোনো দলের না, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তারা তাদের মতো কাজ করবেন৷ কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করার কারণেই কি এই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে?
এদেরকে আমি বলি, গণকর্মচারী। গণকর্মচারী যারা আছেন, তাদের সংবিধান, বিধিবিধান, আইন-কানুনের মধ্য দিয়ে কাজ করার কথা। সেটা করাটাই সঙ্গত। আমরা অনেক বছর ধরে দেখছি, একেবারে প্রথম থেকেই, বিশেষ করে স্বাধীনতার পরপর কিছু কর্মকর্তা দলবাজ হিসেবে আচরণ করতো। তারা দলের প্রতি অন্ধ হয়ে কিছু কথাবার্তা বলতো। দিনে দিনে এটা বাড়তে বাড়তে চরম পর্যায়ে চলে গেছে। তার ফলে তাদের যে জনগণের সেবক হিসেবে সংবিধান ও বিধিবিধান অনুযায়ী কাজ করার কথা, সেটা না করে দলীয় কর্মীর মতো আচরণ শুরু করেন। এসব কারণে পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে তারা একটা দলের সমর্থক বা অন্ধ আনুগত্য পোষণ করে তাদের সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই কারণে আরেক দল তৈরি হয়ে যায়। যারা বঞ্চিত থাকে, বিক্ষুব্ধ থাকে। অবশ্যই এই বিশৃঙ্খলার জন্য গণকর্মচারীদের পলিসি পর্যায়ে যারা আছেন, তারা এই কাজ করে থাকেন।
আমরা দেখছি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে একদল কর্মচারী বিক্ষোভ করছেন। তারা প্রধানের পদত্যাগ দাবি করছেন। এই দাবি কি আরেক ধরনের বিশৃংখলা না?
এটা তো অবশ্যই বিশৃঙ্খলা। আমাদের যা কিছু করতে হবে সংবিধান, বিধিবিধান, আইন কানুনের মধ্যে থেকেই। পলিসি পর্যায়ে যে কর্মকর্তা আছেন, তার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে, সেটা সত্যি হয় এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়, সেটা অবশ্যই সরকার নেবে। কর্মচারীদের মিছিল করে বা চাপ দিয়ে করার তো কথা না। যে আন্দোলনটা হলো, গণতান্ত্রিক, মানবিক, আইনের শাসনের বাংলাদেশ। সকলের জন্য আইন প্রযোজ্য হতে হবে। কারো যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের কাছে দিতে পারেন। চাইলে দেখাও করতে পারেন, আলাপ-আলোচনাও করতে পারেন। কিন্তু মিছিল-মিটিং করা, দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অবশ্যই বিশৃঙ্খলা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে এটা যায় না।
এবার দেখছি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা পদত্যাগ করছেন। এর আগে কখনোই এত বেশি পদত্যাগ দেখা যায়নি, এবার এত পদত্যাগ কেন?
এত বেশি দলবাজ কর্মকর্তাও তো এর আগে দেখা যায়নি। এটাই কারণ। ১৫ বছর ধরে একটি দল ক্ষমতায় থাকার জন্য আমাদের কর্মকর্তাদের হয়ত মনে হয়েছে দলটাই করতে হবে। তা না হলে হয়ত আমি পদোন্নতি পাবো না, চাকরি করতে পারবো না। এ কারণে সংস্কৃতিতে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন চলে এসেছিল। সেটা একটা কারণ হতে পারে। প্রশাসনে অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছিল। আপনারা জানেন চুক্তিভিত্তিক চাকরি মানে তুষ্টির চাকরি। মনিবকে খুশি করার চাকরি। জনগণকে খুশি করার চাকরি না। যিনি চুক্তি দেবেন, তারই সব কথা আমরা শুনবো। এসব কারণে যারা চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ছিলেন, তাদের অনেকেই পদত্যাগ করছেন। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। সব ধরনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। কারণ, তারা আগের সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা ওই সরকারের একেবারেই আজ্ঞাবহ ছিলেন বলেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। আর যারা চুক্তিতে আছেন, তাদের নৈতিকতা থাকলে তারা নিজেরাই সরে যাবেন। কেউ নিজে সরে না গেলে, তাদের সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তো ইতিমধ্যে হয়েছে।
ছাত্ররাও কারো কারো পদত্যাগের দাবি করছেন এবং তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কি শৃঙ্খলা ফিরবে?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটা সরকার গঠিত হয়েছে। ফলে তাদের অনেক কথা থাকতে পারে। তাদের কাছে অনেক তথ্যও থাকতে পারে। তারা এই কথাগুলো তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু বিক্ষোভ করে পদত্যাগ করিয়ে ফেলতে হবে বা সরিয়ে দিতে হবে, তাহলে কিন্তু এটা আবার শৃঙ্খলার মধ্যে থাকলো না। তাদের কথাবার্তা থাকবে, কিন্তু সিদ্ধান্তটা আইনানুগভাবে নিতে হবে। সর্বক্ষেত্রেই সংবিধান, আইন-কানুন ও বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। তাহলেই আমরা বুঝবো যে, একটা গুণগত পরিবর্তন আসছে। আগে যেভাবে হয়েছে, এখনও যদি সেভাবে হয়, তাহলে তো গুণগত পরিবর্তন হলো না। ছাত্র-জনতা যারাই এই অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল লক্ষ লক্ষ কতিপয় নয়, তারা তখন কিন্তু হতাশায় ভুগবেন এবং এই হতাশা আবার জাতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে।
আমরা আগে বাধ্যতামূলক অবসর কিংবা রাজনৈতিক কারণে শাস্তি দেওয়ার সমালোচনা করেছি। কিন্তু এখনো সেটা হচ্ছে। তাহলে রাজনৈতিক সরকারের আমলের চেয়ে এই সরকারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
বাধ্যতামূলক অবসর নিয়ে আমি পরিস্কারভাবে বলতে চাই, ২৫ বছর চাকরি করলে তাকে সরিয়ে দেবেন যে আইনটা ছিল, এটা একটা কালো আইন। এই আইনটা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সেটার প্রয়োগ না করাটাই ভালো। অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয় চিন্তা করবেন এবং এই আইনটা প্রয়োগ করবেন না। এই আইনের বাইরেও আমাদের অনেক ব্যবস্থা আছে। ধরুন, একজন সরকারি কর্মচারী দুর্নীতি করলেন, তাহলে দুর্নীতি দমন আইনে তার বিচার হবে। ধরেন, কেউ অপরাধ করলেন, তাহলে ফৌজদারি আইনে তার বিচার হবে। যদি কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন, অদক্ষ হন তাহলে সার্ভিসরুল অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা হবে। আমাদের কাছে তো আইন -কানুন সবই আছে। আইন-কানুন অনুসরণ করাটাই সঙ্গত হবে।
আমরা মঙ্গলবার দেখলাম, পুলিশ দুই জন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের একজন সাবেক মন্ত্রী এবং একজন সাবেক উপদেষ্টা। তাদের গ্রেপ্তারের পর পুলিশ যে গল্প বললো, যেটা আমরা আগের সরকারের সময়ও দেখেছি। পার্থক্য তাহলে কী হলো?
প্রথমত, পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না থাকলে পুলিশের কাছে এখনও ৫৪ ধারার নামে কালাকানুন আছে। ৫৪ ধারা তো আর বাতিল হয়ে যায়নি। এই ধারাতেও তারা কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। আমি যে ছবি দেখলাম, তাদের হাত বেঁধে নৌকার পাটাতনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, আমাদের হাতকড়া পরানো বা কাউকে বেঁধে রাখার বিষয়ে পুলিশের আইনে বা আদালতের অনেক পর্যবেক্ষণ আছে। এটা ঠিক হয়নি, একই রকম ঘটনা ঘটলো। দ্বিতীয়ত, তাদের যে মামলায় আসামি করা হলো ইন্ধনদাতা হিসেবে, এই মামলাগুলোও অতীতে একইভাবে করা হয়েছিল। হয়ত গাড়ি পুড়েছে সিলেটে, মামলার আসামি করা হয়েছে ফখরুল সাহেবকে। তিনি হয়ত তখন ঢাকায় ছিলেন। এবারও একই ধরনের গল্প বলা হলো। আমি আশা করবো. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটা লক্ষ্য করবেন। এই ধরনের গল্প বা কাহিনি বানানো থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বারণ করবেন। এইসব মামলায় কিন্তু আদতে কিছুই হয় না। আমরা তো বুঝতেই পারি, আগের বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে, এই মামলাগুলোর কোনোটাই কোর্টে প্রমান করা যাবে না। বরং তারা যদি কোনো বড় অপরাধ করে থাকেন, অর্থাৎ, ফৌজদারি বা দুর্নীতি করে থাকেন, তাহলে সেই মামলাগুলো হারিয়ে যাবে। এই মামলায় তাদের কিছুই হবে না। ৫ বছর বা ৪ বছর বা ৩ বছর পর হয়ত তারা বেরিয়ে আসবেন। এই যে গল্পের প্লট, সেটা তো আমাদের অভ্যাসে রয়ে গেছে। আমরা তো এতদিন এগুলো প্যাকটিস করেছি। অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে সময় লাগবে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশে এখন অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ আছে। অনেক কিছু নিয়ে তারা ব্যস্ত আছেন। এগুলোও কিন্তু চ্যালেঞ্জের অংশ।
এখন যে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কি ভবিষ্যতে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে?
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে বিশেষ পরিস্থিতিতে একটা সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকারের শপথ নেওয়ার আগে আমাদের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল। ফলে এখন যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেটা আইনের চোখে বৈধ সরকার। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। ফলে এই সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবে না, যদি না তারা ভুল পদক্ষেপ নেন। যে সরকারই হোক, তারা যদি ভুল করেন, সংবিধানের বাইরে কাজ করেন, আইনের বাইরে কাজ করেন, তারা যদি অন্যায় আচরণ করেন, অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যাবে। প্রশ্ন তোলা যাবে না- এমন কোনো বিধিনিষেধ তো নেই। প্রশ্ন তোলাটাই তো যৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক। আমাদের তো গণতন্ত্রের জন্য এই লড়াইটা হয়েছে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দেশে সত্যিকারের শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে কি করা প্রয়োজন?
এই মুহুর্তে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণটাই সরকারের জন্য বড় কাজ। তারপর প্রশাসন পূর্ণগঠন করতে হবে। সংস্কারের অনেক দাবি আছে। সুতারাং আমাদের প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগে বড় সংস্কারের দরকার আছে। সেজন্য কমিশন করা যেতে পারে। কমিটি করা যেতে পারে। নির্মোহ বিশেষজ্ঞ বা নির্মোহ মানুষদের নিয়ে যারা এইসব সেক্টরে কাজ করেছেন বা জানেন, তাদের নিয়ে কমিশন করে বড় সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আর স্বল্প মেয়াদে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগে যারা অতিমাত্রায় দলবাজ হয়ে গেছেন বা দলীয় ভিত্তিতে যাদের নিয়োগ হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে, তাদের ব্যাপারে নির্মোহভাবে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার। প্রাথমিকভাবে কিছু মানুষকে কাজ থেকে সরিয়ে নিতে পারে। পুলিশকে যেমন পুলিশ সদর দপ্তরে ওএসডি, প্রশাসনের লোকজনকে জনপ্রশাসনে ওএসডি করতে পারে। যদিও আমি এটাকে খুব বেশি সমর্থন করি না। এরপর আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে তাদের বিষয়ে তদন্ত করে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমান হলে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে না, তাদের কাজে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।