শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪৬ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন৷ ওই দিনই কলকাতা হাইকোর্টের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া আইনি বিধি কেন মেনে চলা হয়নি৷ এর আগে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, শিক্ষক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে যাঁদের শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ আছে, তাঁদের অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ তাঁদের পরে সুযোগ পাবেন, যাঁদের প্রশিক্ষণ নেই, তাঁরা৷
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্কুলগুলির প্রায় ৪০ হাজার শূন্য পদের মধ্যে ২৭ হাজার পদে নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন যে পরীক্ষা নিয়েছিল, তার ফলাফলের ভিত্তিতে যে নিয়োগপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে, সেখানে এই নিয়ম মেনে চলা হয়নি৷ ওই ২৭ হাজার শূন্য শিক্ষক পদের জন্য যে ১৭ লক্ষ আবেদনকারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র এক হাজার জন এই আপত্তি তুলে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন৷ আর তাতেই রাজ্য জুড়ে আটকে গিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ৷ অথচ কিছু সফল প্রার্থী তাঁদের নিয়োগপত্র এর মধ্যেই হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন৷ এবং বলা বাহুল্য, চাকরি পাওয়া যে কোনও বাড়িতেই অত্যন্ত খুশির খবর৷ কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশ সেই খুশিতে জল ঢেলেছে কারণ, নিয়ম মেনে চলেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তর৷
কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ দাবি করছে, বর্তমান তৃণমূল সরকারের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, বিধায়ক অথবা পুরপ্রতিনিধি, পঞ্চায়েত সদস্যদের ঘনিষ্ঠজনেরা, তাঁদের আত্মীয়রা এই নিয়োগ পদ্ধতিতে ঢালাও হারে সফল হয়েছেন, যা নিয়ে অনেক সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ আছে৷ সরকার পক্ষের নেতা-নেত্রীদের নাম করে করে রীতিমত অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁদের কোন কোন আত্মীয় এই সুযোগে স্কুলে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন৷ এই অভিযোগের একাংশও যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হলে বলতে হবে, শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতিমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল, তা অত্যন্ত প্রতীকীভাবে, প্রাথমিক স্তরেই বিনষ্ট হল৷ পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ঠিক এভাবেই শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পদ তথাকথিত নিজেদের লোক দিয়ে ভর্তি করে শিক্ষাব্যবস্থার রাজনীতিকরণ করেছিল৷
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার কী হাল, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক৷ শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুটের হার রীতিমত উদ্বেগজনক৷ কোনও রাজনৈতিক অপপ্রচার নয়, ইউনেস্কোর রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সারা ভারতে, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ওড়িশায় স্কুল-পালানো বা স্কুলে না যাওয়া শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ তবে বিহারে স্কুলছুটদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে, যেমন কমছে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড় এবং মনিপুরে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লক্ষণ সেই তুলনায় আদৌ সুবিধের নয়, বরং রীতিমত অস্বস্তিতেই আছেন ভারত সরকারের সর্বশিক্ষা মিশনের কর্মীরা৷
এবার দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকদের পরিসংখ্যানটা কী৷ ২০০৯ সালে ভারতে সমস্ত শিশুর বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে যে আইন পাস হয়েছিল, তা সব অর্থেই ছিল ঐতিহাসিক৷ সেই আইন অনুযায়ী, প্রতি ৩০ জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকা উচিত৷ সেখানে ভারতের জাতীয় গড় হল প্রতি ৩৪ জন শিশুপিছু একজন করে প্রাথমিক শিক্ষক৷ ব্যতিক্রমী রাজ্য হল মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড বা পশ্চিমবঙ্গের মতো জনবহুল রাজ্য, যেখানে ৬০ জন শিশুর জন্য একজন করে শিক্ষক আছেন৷ তার পরেও শিশুদের স্কুলমুখো করতে সফল হয়েছে ঝাড়খণ্ড, কিন্তু পারেনি পশ্চিমবঙ্গ৷
এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষা রাজ্য সরকারের অন্যতম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত ছিল৷ সারা রাজ্যে ৪০ হাজার শূন্য শিক্ষকপদে উপযুক্ত নিয়োগ হওয়া উচিত ছিল আবশ্যিক৷ কিন্তু আদালতে পরীক্ষার্থীদের একাংশ যে অভিযোগ এনেছেন, যার ভিত্তিতে সরকারের জবাবদিহি চেয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট, তাতে প্রমাণ হচ্ছে, যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি হয়নি শিক্ষক নির্বাচনে৷ আর রাজনৈতিক আত্মীয়তার জেরে নিয়োগের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তা হলে সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার সময় পশ্চিমবঙ্গবাসীদের ভবিষ্যৎ ভেবে!