প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় শুধুই লৌকিকতা
৩ ডিসেম্বর ২০১৮নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা শুধুই লৌকিকতা৷ প্রার্থীরা যে হিসাব দেন, সেটাই মেনে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি৷ তাদের মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় মূলত দু’ধরনের৷ একটা তাঁরা মনোনয়ন পাওয়ার পর যেটা খরচ করেন, সেটা চেষ্টা করলে মনিটরিং করা সম্ভব৷ আরেকটা হলো মনোনয়ন বাণিজ্য৷ বিপুল অংকের টাকা দিয়ে অনেক প্রার্থী মনোনয়ন কিনছেন৷ এটার হিসাব পাওয়া কঠিন৷ কারণ, যিনি টাকা দিচ্ছেন আর যিনি টাকা নিচ্ছেন – এর বাইরে কেউ তো সেটা জানতে পারছে না৷ ফলে এটা নিয়ে ধারণা করা যায়, কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন৷ এটার পরিমাণ যে বিশাল, সেটা ধারণা থেকেই বলা যায়৷ এখন যেটা মনিটরিং করা সম্ভব, সেটাই তো করা হচ্ছে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত এই ব্যয় নিয়ে কাউকে কখনো প্রশ্ন করেছে, এমন নজিরও নেই৷ টিআইবির পক্ষ থেকে এই ব্যয় নিয়ে প্রতি নির্বাচনের পরই রিপোর্ট তৈরি করা হয়৷ কিন্তু সেটাও যে নির্বাচন কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে নেয়, তা-ও কিন্তু না৷ ফলে এখন প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়ের যে সীমারেখা দেয়া হয়েছে তা শুধুই লৌকিকতা মাত্র৷’’
সম্প্রতি রাজধানীতে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনয়ন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনি ব্যয় ২৫ লাখ টাকা থেকে আরো বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন৷ তাঁরা বলেছেন, নির্বাচন একটি উৎসব৷ সেই সঙ্গে ব্যয়বহুলও৷ প্রার্থী চাইলেও কম খরচ করতে পারেন না৷ এ কারণে সরকারের তরফ থেকেও নির্বাচনে প্রার্থীদের অনুদান দেয়ার দাবিও তোলেন অনেক রাজনীতিক৷ ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডবিউজি) এই গোলটেবিলের আয়োজন করেছিল৷
ওই আলোচনায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘‘নির্বাচন এখন ব্যয়বহুল৷ নির্দিষ্ট অর্থে নির্বাচন করা কঠিন৷ আমাদের যে নির্বাচনি ব্যয় বেঁধে দেয়া হয়েছে, তা পরিবর্তন করা দরকার৷’’ তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সরকারি অনুদানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়৷ তাই ভালো উদ্যোগের ক্ষেত্রে দেশের সবার ঐকমত্য পোষণ করা উচিত৷’’
বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক ওই আলোচনায় বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট খরচ বেঁধে দিয়ে নির্বাচন হয় না৷ প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করে দিতে চাইলে অবশ্যই সেটা বাস্তবসম্মত হতে হবে৷ আমলারা এটা ঠিক করে দিলে হবে না৷ কারণ, তাঁরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের খবর জানেন না৷’’ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে পর্যাপ্ত জনবল নেই৷ সে কারণে তারা যথাযথভাবে নির্বাচনি ব্যয় পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না৷’’
জাতীয় পার্টি (জাপা)-র প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের বলেন, ‘‘নির্বাচনি ব্যয় ২৫ লাখ টাকা যৌক্তিক নয়৷ কোনো রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট খরচ দিয়ে দল পরিচালনা করতে পারে না৷ বিভিন্ন অনুদান নিয়েই দল পরিচালনা করতে হয়৷ নির্বাচনি খরচ হিসেব করে করা যায় না৷ এখানে অনেকগুলো বিষয় থাকে৷’’
রাজনৈতিক নেতারা যে এটা বাড়ানোর জন্য বলছেন এ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখনো তো বাড়ানো হয়নি৷ যতক্ষণ বাড়ানো হচ্ছে না, ততক্ষণ তো যেটা আছে সেটা মানতে হবে৷ আমি তো এটা কমানোর পক্ষে৷ কারণ, এখন নির্বাচনি খরচ এতই বেড়েছে যে, কোনো ভালো মানুষ, সৎ মানুষ নির্বাচনে আসতে সাহস করেন না৷ এটা একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে৷ যে বেশি টাকা খরচ করতে পারবে, সে-ই মনোনয়ন পাবে – বিষয়টা এমন হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷’’
জনাব আহমেদ পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘‘এটা কেন দেয়া হয়? কে এটা মানে? কেনই বা মানবে? না মানলে কি কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়? হয় না৷ তাই কেউ মানেন না৷ আর কেউ যদি এটা না মানেন, তাহলে সেটা ২৫ লাখই বা কি, ২৫ কোটিই বা কি? এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন থেকে প্রার্থীদের এটা মানানোর কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি৷ এবারও কোনো উদ্যোগ নেই৷’’
আসলেই কি নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রার্থীদের খরচ মনিটর করতে পারে? তাছাড়া কোনো প্রার্থীর পক্ষে আদৌ কি সম্ভব তাঁর খরচ ২৫ লাখ টাকার মধ্যে রাখা? পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন তো বলছে, এত প্রার্থীকে মনিটরিংয়ের জন্য তাদের হাতে জনবল নেই৷ তাহলে কীভাবে তারা মনিটরিং করতে পারে?
এ সব প্রশ্নের জবাবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের হাতে জনবল নেই তো কী হয়েছে? সরকারের হাতে তো আছে৷ এখন যদি একটা জেলায় এডিসি রেভিনিউ-এর নেতৃত্বে আরো তিনজন দিয়ে দেন এবং একটি পরিপত্র জারি করে দেন যে, তাঁরা সব প্রার্থীর এজেন্টকে বলবে ‘ডিটেইলস’ হিসাব করে জানাতে হবে৷ এর জন্য আলাদা কোনো জনবলের প্রয়োজন নেই৷ একটা জেলায় ৩০-৩৫ জন ‘ফার্স্ট ক্লাস’ অফিসার আছেন৷ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, জেলা এগ্রিকালচার অফিসারসহ অনেক অফিসার আছেন৷ কেন তাঁদের কাজে লাগানো হচ্ছে না? এখন একটা টিম করতে হলে প্রয়োজনে উপজেলা থেকে অফিসার নিয়ে আসেন৷ আপনি চাইলে তো লোকের অভাব নেই৷ নির্বাচনে যে ৬ থেকে ১২ লাখ লোক লাগছে, সেটা কি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল? তারা তো সরকারের কাছ থেকেই এই জনবল নিচ্ছে৷ তাহলে এখানে সমস্যা কী?’’ তাই তিনি মনে করেন, প্রতিটি জেলায় ফাইনান্সিয়াল মনিটরিং টিম ছাড়া এটা কোনোভাবেই দেখভাল করা সম্ভব নয়৷
এবারও আগের মতোই প্রার্থীদের জামানত নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা৷ নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এটা ৫০ হাজার টাকা করার উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি৷
নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার সার্বিক নির্বাচনি ব্যয় চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে৷ প্রার্থীদের ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্পে বরাদ্দ, নির্বাচন কমিশন ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যয়, আনসারদের অতিরিক্ত ভাতা ও আনুষঙ্গিক কাজে বিপুল এ অর্থ খরচ হবে৷
সম্প্রতি ব্যয় প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা ও আইন-শৃঙ্খলার জন্য নির্বাচন কমিশন ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন দিয়েছে৷ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৪ সালে এই ব্যয় ছিল ২৯৩ কোটি টাকা৷
সূত্র জানিয়েছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে৷ গোয়েন্দা সংস্থার প্রস্তুতিমূলক ব্যয় ৩০ কোটি টাকা, আনসারদের বর্ধিত ভাতায় ব্যয় হবে ২৪৩ কোটি টাকা৷
এছাড়া প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন ফর্ম কিনতে ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের খরচ হয় ১২ কোটি টাকা৷ দলটির ৪ হাজার মনোয়ন ফর্ম কিনেছেন প্রার্থীরা৷ সাড়ে ৪ হাজার ফর্ম কেনায় ১৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে বিএনপির প্রার্থীদেরও৷ জাতীয় পার্টির ফর্ম কিনেছেন ২ হাজার ৪১৮ জন প্রার্থী৷ এতে ব্যয় হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা৷ এর বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতে প্রার্থীদের ব্যয় হয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি৷ এর বাইরেও প্রার্থীদের নির্বাচনি খরচ তো আছেই৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷