জলবায়ু শরণার্থী
২১ জুলাই ২০১৫২০০৭ সাল থেকে কিরিবাতি ছেড়ে নিউজিল্যান্ডে বাস করছেন ইয়োয়ানে টাইশোটা৷ সঙ্গে আছেন তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকায় অদূর ভবিষ্যতে কিরিবাতির জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে সেগুলো শস্য ফলানোর অযোগ্য হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সে দেশের সরকারের৷ তাই আরেক রাষ্ট্র ফিজির কাছ থেকে ইতিমধ্যে দুই হাজার হেক্টর জমি কিনে নিয়েছে কিরিবাতি৷ উদ্দেশ্য একটাই, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে সেখানে শস্য ফলানো৷ এছাড়া চলতি শতক শেষে সাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়ার যে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা, সেটা যদি ঠিক হয় তাহলে পুরো কিরিবাতি ডুবে যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে দেশের সব নাগরিকদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া, এমনকি নতুন করে দ্বীপ তৈরিরও চিন্তাভাবনা করছে সরকার৷
এই পরিস্থিতিতে টাইশোটা কিরিবাতি ছেড়ে নিউজিল্যান্ডে চলে যান৷ পরে শরণার্থী হিসেবে সেখানে থেকে যাওয়ার আবেদন করেন৷ কিন্তু আদালত এই বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে যে, আন্তর্জাতিক শরণার্থী বিষয়ক আইনে শরণার্থীর যে সংজ্ঞা রয়েছে তার আওতায় পড়েন না টাইশোটা৷ কারণ এই অবস্থায় দেশে ফিরে গেলে তিনি কোনোরকম হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হবেন না! আইন অনুযায়ী, যুদ্ধ কিংবা অন্য কোনো কারণে কেউ মাববাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলেই কেবল একজন শরণার্থী হওয়ার আবেদন করতে পারেন৷জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার যাঁরা হন, তাঁদের এখনও আইনত শরণার্থী বলা হচ্ছে না৷ তাই টাইশোটাও বিশ্বের প্রথম ‘জলবায়ু শরণার্থী' হতে পারলেন না৷
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের আদালত টাইশোটার আবেদন গ্রহণ না করলেও স্বীকার করেছে যে, কিরিবাতির মানুষ পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছেন৷
আমার প্রশ্ন এখানেই৷ অন্যের কারণে একজন মানুষের গৃহহীন হওয়া কেন মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে না? টাইশোটা তো শখ করে নিউজিল্যান্ডে বসবাস করতে যাননি৷ তিনি কিরিবাতিতে থাকাটা নিরাপদ মনে করেননি তাই দেশ ছেড়েছেন৷ তাঁর মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি হয়েছে, তার জন্য তো তিনি নিজে দায়ী নন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী রাষ্ট্রগুলোই সেজন্য দায়ী৷ তাহলে কেন তাঁকে অন্য দেশে থাকার সুযোগ দেয়া হবে না?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে অনেক মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন সেটা জানেন সবাই৷ সে বিষয়ে কী করা যায় তা নিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনেও আলোচনা হয়েছে৷ কিন্তু তাদের ‘শরণার্থী' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি সেভাবে আলোচিত হয়নি৷ হয়ত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো সেটা হতে দিতে চায়নি৷ কারণটা অবশ্য সহজে অনুমান করা যায়৷ তেমনটা হলে ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দরিদ্র দেশের মানুষদের থাকার জায়গা দিতে হবে৷ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এমনিতেই যুদ্ধ আর সংঘাতে লিপ্ত দেশের অভিবাসীদের নিয়ে বিপদে রয়েছে ধনী দেশগুলো৷ সেখানে নতুন করে জলবায়ু শরণার্থীদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না৷ জলবায়ু শরণার্থী তৈরি করার জন্য তো তারাই (ধনী দেশগুলো) দায়ী৷ তাই সমাধানও তাদেরই বের করতে হবে৷ আর সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে জাতিসংঘকে৷ অন্তত আলোচনা শুরু করতে হবে৷ তারপর হয়ত একসময় সমাধান বেরিয়ে আসবে৷ কিন্তু আগে তো আলোচনাটা শুরু করতে হবে৷