মহাত্মার স্মৃতি আগলে রেখেছেন যিনি
৩০ জানুয়ারি ২০১৮ডয়চে ভেলে: ১৯৪৭ সালে গান্ধিজি কলকাতায় এসেছিলেন৷ বেলেঘাটা অঞ্চলে আজকের গান্ধি ভবনেই কি আপনি গান্ধিজিকে দেখেছিলেন?
চণ্ডী সেনগুপ্ত: তখন গান্ধি ভবনের নাম ছিল হায়দারি মঞ্জিল৷ ঠিকানা ১৫০ বি বেলেঘাটা মেন রোড৷ আজকের মতো এমন সুন্দর সাজানোও ছিল না৷ মালকিন ছিলেন বৃদ্ধা বেগম আম্মা৷ বাড়িটার তখন জরাজীর্ণ অবস্থা৷ পিছনে একটা পুকুর৷ তখন তার নাম হলো গান্ধি ক্যাম্প৷
কত বছর বয়স তখন আপনার?
১২ বছর৷ আমার জন্ম ১৯৩৫ সালে৷
তখন কলকাতার কী অবস্থা?
১৯৪৬-এর দাঙ্গার স্মৃতি তখনও শুকোয়নি৷ পরের বছরই ফের কলকাতায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা৷ দিনটা ছিল ১৩ আগস্ট, ১৯৪৭৷ সেদিনই হায়দারি মঞ্জিলে আসেন বাপু৷
সেই সময়ের গল্প তা হলে বলুন...
আসলে বেলেঘাটায় তখন টানটান উত্তেজনা৷ গান্ধিজিকে ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিল ক্যালকাটা পুলিশ৷ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার বাবা হেমন্ত সেনগুপ্তকে৷ বাবা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বলে সর্বক্ষণ বাপুর পাশে পাশে থাকতেন৷ স্বাধীন ভারতে তিনিই গান্ধিজির সর্বপ্রথম বাঙালি দেহরক্ষী৷ সেই সুবাদে আমার গান্ধি ক্যাম্পে যাতায়াত ছিল৷
কতদিন নিরাপত্তার ভার ছিল তাঁর হাতে?
১৩ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর — এই ২৫ দিন কলকাতায় গান্ধিজির নিরাপত্তার ভার ছিল বাবার হাতে৷ হায়দারি মঞ্জিল থেকে প্রার্থনাসভা, প্রাক-স্বাধীন ও স্বাধীনত্তোর ভারতে বাবাই ছিলেন ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসার এবং বাপুর ছায়াসঙ্গী৷
তখনকার কথা কতটা মনে পড়ে?
অনেকটাই পড়ে৷ বাবার জিপ থাকত গান্ধিজির গাড়ির সামনে৷ সবার আগে চলত সেই ক্যালকাটা পুলিশের জিপ৷ নম্বর ছিল সিপি ৩৭৷ হুডখোলা জিপে বাবা দাঁড়িয়ে থাকতেন৷ বাপুকে দেখতে রাস্তার দু'পাশে জনতার ঢল৷ তারা যাতে গাড়ির সামনে চলে না আসে, তা দেখতেন বাবা৷ সমানে হাত নেড়ে চলতেন হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে৷ গম্ভীর কণ্ঠ ছিল তাঁর৷ বার বার তিনি হাঁক দিয়ে জনতাকে সরে যেতে বলতেন৷
বাবার সঙ্গে আপনি যেতেন হায়দারি মঞ্জিলে?
কতবার গিয়েছি! গান্ধিজির কাছাকাছি মেঝেয় পাতা চাটাইয়ে বসে থাকতাম৷ একটা ঘরেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড৷ সবাইকে জায়গা দেওয়া যেত না৷ জানলায় মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকত কত মানুষ৷ বাপু খাটো ধুতি পরে বসতেন৷ ঘরের দেওয়াল পিঠ দিয়ে৷ তাঁকে ঘিরে পারিষদরা অর্ধেক চাঁদের মতো বৃত্ত করে বসতেন৷ মানু ও আভা গান্ধি থাকতেন সর্বক্ষণ৷ থাকতেন বাপুর সচিব নির্মল বসু৷ রোজ তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন ডাক্তার মেহতা৷ সামনের সারিতে এসে বসতাম আমি৷
মহাত্মা কখনও আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
না, নিজে কখনও বলেননি৷ বার বার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতেন৷ আমি প্রার্থনাসভায় গিয়ে ভাঙা ক্যামেরা দিয়ে তাঁর ছবি তুলতাম৷ বাপু কথা না বললেও নির্মল বসু আমার সঙ্গে কথা বলেছেন টুকটাক, কতজন আদর করেছেন৷
কারা আসতেন গান্ধিজির সঙ্গে দেখা করতে?
তখন কি আর দেখে বুঝতাম! পরে জেনেছি সে সব নাম৷ সুরাবর্দি থেকে রাজা গোপালাচারি, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ থেকে কৃপালিনী৷ বাংলার নেতা জ্যোতি বসু, ভূপেন গুপ্ত, প্রফুল্ল ঘোষ — কত নাম সেই তালিকায়৷
বাবার কাছে সাম্প্রদায়িকতার পরিস্থিতি নিয়ে কী শুনেছেন?
এটা পরে শুনেছি৷ গান্ধিজির অহিংসার আবেদন সত্ত্বেও বেলেঘাটায় গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়েছিল৷ হানাহানি শুরু হয়, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাপাতে থাকে দুষ্কৃতীরা৷ আবেদনে কাজ না হওয়ায় বাপু অনশন শুরু করেন৷ দুষ্কৃতীরা অস্ত্র সমর্পণ না করা পর্যন্ত তিনি কিচ্ছুটি মুখে তুলবেন না৷ কলকাতা পুলিশও অস্ত্র উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ নেতৃত্বে ছিলেন আমার বাবা৷ দুষ্কৃতীরা অস্ত্র জমা দিয়ে যায় বাবার কাছে৷ খবরের কাগজে বাবার ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল৷ অস্ত্রগুলো রয়েছে আজকের গান্ধি ভবনে৷
বাপুর কথা আর কী শুনেছেন, কী দেখেছেন?
খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন বাপু৷ শেষ রাতে তিনি বিছানা ছাড়তেন৷ সূর্যের আলো ফোটার আগে প্রার্থনা সেরে নিতেন বাড়ির ভেতরেই৷ তারপর বাইরে বেরিয়ে খানিকটা পায়চারি করে কিছুক্ষণ ঘুমোতেন৷ উঠে ম্যাসাজ-স্নান ও প্রাতঃরাশ৷ এরপর হায়দারি মঞ্জিলের বাঁদিকের ঘরটায় গিয়ে বসতেন৷ ওখানেই হরিজন পত্রিকার কাজ হতো৷
পত্রিকার কাজ কীভাবে চলত?
আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে গান্ধিজি নিজের পত্রিকার কাজ সেরে নিতেন৷ তিনি বলে যেতেন, পার্শ্বচররা নোট নিতেন৷ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ত৷ জনতার মধ্যে ছিল একদল অটোগ্রাফ শিকারী৷ হরিজন তহবিলে পাঁচ টাকা দিলে গান্ধিজির সই মিলত৷ সাদা কাগজে মহাত্মা শুধু লিখতেন ‘চিরঞ্জীব', তার নীচে অনুরাগীর নাম৷ আমাকেও অটোগ্রাফ দিয়েছেন বাপু৷ তাঁর জন্য অনেকেই ফল ও মিষ্টি নিয়ে আসতেন৷ রোজই তার ভাগ পেতাম৷
কখনও কোনো সভায় গিয়ে বাপুর কথা শুনেছেন?
হ্যাঁ৷ রোজ গান্ধিজি বিভিন্ন স্থানে প্রার্থনা সভা করতে যেতেন৷ সুরাবর্দি কয়েকদিন নিজেই গাড়ি চালিয়ে তাঁকে প্রার্থনাসভায় নিয়ে গিয়েছেন৷ শহরের ধনী ব্যক্তিরাও গাড়ি নিয়ে আসতেন বাপুর জন্য৷ স্থানীয় কোনো মাঠে বসত সেই সভা৷ প্রার্থনা সভা হয়েছে ময়দানের মনুমেন্টের নীচে৷ কাছেই মহামেডান স্পোর্টিংয়ের মাঠ৷ প্রবল বৃষ্টিতে থকথকে কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে কত মানু্ষ বাপুর কথা শুনেছে৷ যূথিকা রায়, বিজনবালার মত কণ্ঠশিল্পীরাও থাকতেন সভায়৷
এবার ১৫ আগস্টের কথা জানতে চাইব...
কালীঘাটে তখন আমাদের বাসা৷ ১৫ আগস্ট আমি হায়দারি মঞ্জিলে যাইনি৷ নিজের ভাঙা ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম শহরের রাস্তায়৷ যা দেখেছি, তার ছবি তুলেছি৷
আর বাপু?
শুনেছিলাম ওই দিন ভোর দুটোয় ঘুম থেকে উঠেছিলেন তিনি৷ মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েকজন প্রতিনিধি তখনই চলে এসেছেন হায়দারি মঞ্জিলে৷ তাঁদের একটাই ইচ্ছে, জাতির জনককে দর্শন করে রোজা ভাঙবেন৷ সেখানে হিন্দুরাও ছিলেন৷ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, পরবর্তীকালে যিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি বাপুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন৷ সুরাবর্দির অনুরোধে গাড়ি চড়ে শহর ঘোরেন তিনি৷ বাপু দেখলেন, হিন্দু-মুসলিম হাত ধরাধরি করে ঘুরছে৷ হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই স্লোগান উঠেছে৷ শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তিনি যখন যান, মহাত্মার নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল৷
আজকে মৌলবাদীরা যখন উপমহাদেশে খুব সক্রিয়, সেই সময় গান্ধিজির বাণী কতটা কাজে আসতে পারে?
বাপু তাঁর কাজেই পথ দেখিয়েছেন৷ ১৩ আগস্টের ঘটনা বলি৷ সেদিন গান্ধিজি বেলেঘাটায় আসতেই কয়েকজন হিন্দু যুবক তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখায়৷ তাদের বক্তব্য, ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছিল৷ সে সময় তাদের রক্ষা করার কেউ ছিল না৷ এখন কেন আপনি মুসলিমদের বাঁচাতে এসেছেন? তাদের শান্ত করে বাপু বলেন, আগেকার ঘটনার কথা তুলে এখন প্রতিশোধ নেওয়া উচিত নয়৷ যারা হত্যা করছে, আগুন লাগাচ্ছে, লুঠ করছে, তারা নিজেদের ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে৷ নোয়াখালির মুসলিম নেতাদের আমি বলেছি, যদি ওখানে আবার দাঙ্গা শুরু হয়, তা হলে আমাকে আগে হত্যা করতে হবে৷ গত বছরের কথা তুলে কেন এই সময়কে আপনারা বিষাক্ত করছেন? আপনারা যতই প্রতিবাদ করুন, আমি এই এলাকা ছাড়ব না৷ আমার নাম, আমার কাজ, সবটাই প্রমাণ করে আমি হিন্দু৷ এ সব শুনে যুবকরা শান্ত হয়, গান্ধিজির পাশে দাঁড়ায়৷
সাত দশক আগে গান্ধিজিকে হত্যা করা হয়েছিল....১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারির কথা কিছু মনে পড়ে?
পড়ে বৈকি৷ হাজরার কালিকা হলে পুলিশের একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ সময় পার হয়ে গেলেও পর্দা উঠছিল না৷ একজন এসে গান্ধিজির হত্যার খবর ঘোষণা করলেন৷ বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন কাছের ভবানীপুর থানায়৷ মহাত্মার হত্যার খবরে শহরে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় ফোন ঘুরিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ মোতায়েনের কথা বলছিলেন৷ ব্যক্তিগত আবেগ ঝেড়ে ফেলে তিনি ছুটেছিলেন দায়িত্ব সামলাতে৷
সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷