1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফসল নষ্ট খেতে, তোলার লোক নেই

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
২০ এপ্রিল ২০২০

ফসল নষ্ট হচ্ছে মাঠে। তোলার লোক মিলছে না। যদি বা তোলা হচ্ছে, বিক্রির বাজারে মন্দা। চরম সংকটে কৃষকরা।

https://p.dw.com/p/3bA5g
ছবি: Krishna Gaddam

ভারতে কৃষকদের আত্মহত্যা এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে। গত এক দশকে শুধু ঋণের দায়ে কয়েক হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। লকডাউনের বাজারে তাঁদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে চলেছে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল উঠছে সরকারের দিকে। দেশে অধিকাংশ কৃষকের অবস্থা কতটা দুর্বিসহ তা সকলেরই জানা। তার পরেও কেন লকডাউনের সময় তাঁদের কথা ভাবা হলো না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি।

রাজনৈতিক বিতর্কে শেষ পর্যন্ত কোনও সুরাহা মেলে না। মিললে, ২০১৮ এবং '১৯ সালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের লং মার্চ সরকারকে ভাবিত করতো। অনেকে ভেবেছিলেন লাভ হবে। কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ হবে। কিন্তু হয়নি। কিছু ফসলে লোক দেখানো ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই তার চেয়ে কম দামে মহাজনদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা। কারণ, মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া আছে। এটাই বাস্তব পরিস্থিতি। সেই বাস্তবতার মধ্যেই করোনা সংক্রমণ। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে আচমকা লকডাউন ঘোষণা করল সরকার। বলা বাহুল্য, করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে ভারতে লকডাউনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার আগে কিছু পরিকল্পনারও প্রয়োজন ছিল। বিশেষত গরিব শ্রমিক এবং কৃষকদের স্বার্থে। সরকার যে সে কথা ভাবেইনি, বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে মোটের উপর স্পষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের অবস্থা শুধু দেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছে। হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। এ বার মাথায় হাত কৃষকদের। মাঠে ফসল পেকে গিয়েছে। কিন্তু তা তোলার লোক নেই। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো কৃষি নির্ভর রাজ্যে ফসল তোলার শ্রমিকই পাওয়া যাচ্ছে না।

বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে বোঝা সহজ হবে। ফসল তোলার সময় মূলত দু'টি পদ্ধতি ব্যবহার করেন কৃষকরা। এক, হার্ভেস্টর নামক যন্ত্রের সাহায্যে বড় জমির ফসল তোলা হয়। এবং দুই, দিন মজুর বা পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যবহার করে ছোট জমির ফসল তোলা হয়। এর পর সেই ফসল হিমঘরে নিয়ে যাওয়া কিংবা বাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

লাল মরিচে ফিরেছে কৃষকের ভাগ্য

রোববার কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, লকডাউনের মধ্যেও ফসল তোলা যাবে। কিন্তু সেই ফসল তুলবে কে? হরিয়ানার কৃষক মহেশ কুমার সিংহ জানিয়েছেন, ফসল তোলার সময় যে শ্রমিকরা আসেন, তাঁদের অধিকাংশই ভিন রাজ্যের। কিন্তু সেই শ্রমিকদের যাতায়াতের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। বস্তুত, সরকার জানিয়েছে, ফসল তোলার কাজ করা গেলেও রাজ্যের বাইরে যাতায়াত করা যাবে না। ফলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো বড় জমির রাজ্যে ফসল তোলার কাজ করাই যাচ্ছে না। মহেশের বক্তব্য, ''হার্ভেস্টর যন্ত্রও এখন আমাদের হাতে নেই। শীতকালে তা পশ্চিম এবং মধ্য ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ সেখানে তখন শীতের ফসল ওঠে। গরমে তা পশ্চিম থেকে আমাদের কাছে চলে আসে। এ বছর সেই যন্ত্র ওরা পাঠাতে পারেনি।'' মহেশের হিসেব বলছে, হার্ভেস্টরের সাহায্যে ৩ দিনে একটি জমির ফসল তুলে ফেলা যায়। মাঝারি জমিতে লোক লাগালে খুব বেশি হলে দিন পাঁচেক সময় লাগে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব চেষ্টা করলেও পুরো জমির ফসল তিন সপ্তাহের আগে তোলা সম্ভব নয়।

এতেই সমস্যা শেষ হচ্ছে না। মধ্যপ্রদেশের কৃষক রাজু জানিয়েছেন, এখন ফসল তুললে আরও ক্ষতি। কারণ, বাজারে তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। উৎপাদনের দামও মিলছে না। ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আরও কিছুদিন মাঠেই ফসল ফেলে রাখার। বাজার একটু ভালো হলে তা তোলা হবে। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কৃষক কেদার মণ্ডল। ধান পেকে গেলেও লোকের অভাবে তুলতে পারছিলেন না। মাঠে ফেলে রেখেছিলেন। রোববার রাতে কালবৈশাখী এসে সব ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। কেদারবাবুর কথায়, ''এমনিতেই আজকাল ধানের দাম পাওয়া যায় না। তার উপর এ বার যা হলো, তাতে ধনেপ্রাণে শেষ হয়ে গেলাম। লকডাউনের জন্য মহাজন তো আর ঋণ মকুব করবে না!''

মহারাষ্ট্রের কৃষক নেতা রাজু শেট্টি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''কৃষকদের সমস্যার একটা চেইন তৈরি হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিক নেই বলে ফসল তোলা যাচ্ছে না। যেটুকু তোলা যাচ্ছে তা হিম ঘর বা বাজারে নিয়ে যাওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। যদি বা নিয়ে যাওয়া যায়, সেখানে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদনেরও কম দামে ফসল বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। আর যাঁরা ফসল ফেলে রাখছেন, ঝড়বৃষ্টিতে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কৃষকের যা ক্ষতি হচ্ছে, তা আগামী বছরেও পূরণ হবে না। ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে।''

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

বোঝার জন্য সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গে ভুট্টা বিক্রি হয় প্রতি কুইন্টাল কম বেশি দুই হাজার টাকায়। এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে হাজার থেকে বারোশ টাকায়। মহারাষ্ট্রে গম বিক্রি হয় প্রতি কুইন্টাল চার হাজার ৮৭৫ টাকায়। ওটাই গমের সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম দাম। এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। রাজস্থানে শর্ষে বিক্রি হয় প্রতি কুইন্টাল তিন হাজার ৬০০ টাকায়। এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকায়। কর্ণাটকে গত বছর টমেটো বিক্রি হয়েছে প্রতি কুইন্টাল তেরোশ টাকায়। এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়। প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে কৃষকের। কিন্তু সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রতি বছরই কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার নানা রকম আশ্বাসবাণী দেয়। গাল ভরা প্রকল্প ঘোষণা হয়। কিন্তু বাস্তবে কৃষকরা তার কতটা সুযোগ সুবিধা পান? কেদারবাবুর কথায়, সেই সুযোগ যে কী ভাবে পেতে হয়, তা-ই তো জানেন না অধিকাংশ কৃষক। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে ছোট কৃষকদের সরকারি কার্ড, কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড অধিকাংশ সময়েই গচ্ছিত থাকে মহাজনদের কাছে। অভিযোগ, সরকারের দেওয়া সুযোগ সুবিধা তাঁরাই তুলে নেন। গরিব কৃষকের হাতে তা পৌঁছয় না। কৃষক এর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেন না কারণ, মহাজনের কাছে তিনি ঋণে বাঁধা পড়ে আছেন। এ এক জটিল সমস্যা। লকডাউন তার মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এই সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু অন্তত গত এক দশকের ইতিহাস বলছে, সরকার গভীরে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান কখনওই করতে চায়নি। ফলে এ বারে তা অন্যরকম হবে, এমন ভাবার কারণ নেই। গরিব কৃষকের কথা কে কবে ভেবেছে? ভোট রাজনীতিতে সাধারণ কৃষকের সমস্যা এখনও ততটা প্রভাব ফেলে না এ দেশে। বছরে ছয় হাজার টাকা দিয়ে দিলেই তো তাঁদের ভোট পাওয়া যায়, তা হলে আর অসুবিধা কোথায়! 

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো