ফুটবলে ‘জার্মান যুগের’ সূচনা
২৫ এপ্রিল ২০১৩বার্সা এবং রেয়াল, রেয়াল এবং বার্সা৷ তারপরই আসে স্পেনের জাতীয় দলের কথা৷ সেই জাতীয় দলের জনা দশেক খেলোয়াড় রেয়ালের কোচ মুরিনহো সঙ্গে করেই এনেছিলেন৷ সেই সঙ্গে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো নামের ফুটবলের এক ব্রহ্মাস্ত্র৷ সব অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেল৷ কিসে? সেটাই তো প্রশ্ন!
বার্সার শর্ট পাসিংয়ের টিকি-টাকা, লা মাসিয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে উঠে আসা তরুণ প্রতিভারা – এসব কি এক ধাক্কায় তামাদি হয়ে গেল? তা নয়৷ ফুটবল যদি শিল্পকলা হয়, তাহলে ফুটবলের এই শৈলী যে কী ধরনের সাফল্য এনে দিতে পারে এবং অতীতে এনেও দিয়েছে, তা ভোলার নয়৷ সেই সাফল্য বার্সার, সেই সাফল্য স্পেনের৷
তরুণের স্বপ্ন
বলতে কি, যেন স্পেনীয় ফুটবলের সেই মহিরুহর ছত্রছায়াতেই যে কখন জার্মান ফুটবলের তরুণ, সতেজ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ধারাটি গজিয়ে উঠেছে, সেটা যেন কেউ খেয়াল করেনি৷ জার্মানরাও নয়৷ বার্সার বিপক্ষে বায়ার্নের জয়ের পর ক্লাবের সাম্মানিক প্রেসিডেন্ট কার্ল-হাইনৎস রুমেনিগেকে বলতে শোনা গেছে, ‘‘এটা অবিশ্বাস্য, এটা একটা স্বপ্ন৷'' রেয়ালের বিপক্ষে ডর্টমু্ন্ডের খেলার আগে আত্মপ্রত্যয় যদি কিছু বেশি হয়ে থাকে, তবে সেটা রেয়ালের সঙ্গে দু'টি হালের মোলাকাতের উপর ভিত্তি করে৷
চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালের প্রথম লেগ থেকে যুগান্তরের কথা বলা যায় কিনা জানিনা৷ কিন্তু মঙ্গলবার এবং বুধবারের ম্যাচ দুটির ফলাফল ফুটবলে এক পালাবদলের পালার সাক্ষী হয়ে থাকবে বলেই বিশ্বাস৷ ইংরিজিতে যাকে বলে ‘চেঞ্জিং অফ দ্য গার্ড'৷ টেনিস থেকে পাওয়ার টেনিসে উত্তরণ, তারও আগে ধ্যানচাঁদের আমলের হকি থেকে আধুনিক ফিল্ড হকিতে আসা, এসব যাদের স্মরণে আছে, তারা হয়ত দেখতে পাবেন ‘দ্য সাইন অফ দ্য টাইমস'৷
জার্মান জাতীয় একাদশে হঠাৎ তরুণ খেলোয়াড়দের আনা এবং তার ফলে সেই দল ও তার খেলার ভোল পাল্টে যাওয়া থেকেই হয়ত এসবের সূচনা হয়েছিল৷ যার জন্য অবশ্যই জাতীয় দলের কোচ ইওয়াখিম ল্যোভকে ধন্যবাদ জানাতে হয়৷ জাতীয় একাদশ থেকে এই তারুণ্যের ছোঁয়া কখন যে সারা বুন্ডেসলিগায় ছড়িয়ে পড়ে, সেটা হয়ত ফুটবল বিশেষজ্ঞরা খেয়াল করেছেন৷ তবে ডর্টমুন্ডের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ যে একটি তরুণ দল গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন, সেটা সুবিদিত৷
বারো আনা ফারাক
দ্বিতীয়ত, বুন্ডেসলিগার জার্মান ক্লাবগুলো কখনোই স্টার সিস্টেমে বিশ্বাস করেনি এবং আজও করে না, যাবতীয় রবেন-রিবেরি সত্ত্বেও৷ ইংল্যান্ড, ইটালি কিংবা স্পেনের ক্লাবগুলোর মতো বিপুল খরচে নামকরা খেলোয়াড়দের এনে একদিকে ট্রফি জেতা, অন্যদিকে জার্সি বেচার যে রথ-দেখা-কলা-বেচার মহাজনপন্থা, জার্মান ক্লাগুলো তা কোনোদিনই অনুসরণ করেনি৷ জার্মান ক্লাবগুলো আবার হিসেবীও: তারা কাপড় মেপে কোট কাটায় বিশ্বাসী৷
লোকের কাছে তা কিপ্টেমি বলেও মনে হতে পারে! অথচ সেই ‘কিপ্টেমি'-র কারণেই জার্মানিতে তরুণ প্রতিভারা বুন্ডেসলিগার ক্লাবগুলো থেকে জাতীয় দলে উঠে আসে৷ জার্মান ফুটবল সমিতি ডিএফবি বেশ কয়েক বছর ধরে ক্লাবগুলোকে যুব-কিশোর পর্যায়ে প্রতিভা খোঁজার কাজে নিবদ্ধ করেছে৷ মজার কথা, এসবই কিন্তু স্পেনের অনুকরণে৷ যেমন ফুটবলার হিসেবে আজকের জার্মান খেলোয়াড়রা যে সব স্কিল বা দক্ষতাগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছে, সেগুলোর উৎপত্তিও এক হিসেবে স্পেনে৷
জার্মান উপাদান
সঙ্গে বিশেষভাবে যে জার্মান উপাদানগুলো যুক্ত হয়েছে, সেগুলি হলো শারীরিক শক্তি ও ক্ষিপ্রতা; শৃঙ্খলা, যা কিনা জার্মান স্বভাব-প্রকৃতি; সেই সঙ্গে নাছোড়বান্দা মনোভাব, যার ফলে খেলোয়াড়রা নব্বই মিনিট দৌড়ে যেতে পারে, লড়ে যেতে পারে৷ জার্মানরা কখনো হাল ছাড়ে না৷
ওদিকে জার্মানরা কখনো ডিফেন্স বা রক্ষণাত্মক খেলাকেও অবহেলা করে না, তা তাদের আক্রমনভাগ যতই শক্তিশালী হোক না কেন৷ জার্মান গোলরক্ষক অনেকের মতেই এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা৷ বিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়ের পিছনে জোঁকের মতো লেগে থেকে তার জীবনটা দুর্বিষহ করে তোলা, তাকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দেওয়া – এই কৌশলের উদ্ভাবন ইংল্যান্ডে হলেও, জার্মানরাই আজ এর ওস্তাদ৷ বুধবার রেয়ালের বিপক্ষে ডর্টমুন্ডের পিসেক কিন্তু এ কৌশলেই রোনাল্ডোকে প্রায় সত্তর ভাগ নিষ্ক্রিয় রেখেছিলেন৷
শেষমেশ এটুকু না বললে অন্যায় হবে যে, ডর্টমুন্ডের হয়ে রেয়ালের বিপক্ষে যে একাই চার গোল করেছেন, সেই রবার্ট লেভান্ডোভস্কি আসলে পোল্যান্ডের জাতীয় দলের খেলোয়াড়৷ এছাড়া ডর্টমুন্ড দলে পিসেক কিংবা ব্লাজিকোভস্কির উপস্থিতিও এ কথাই বলছে যে, আমরা শুধু জার্মান ফুটবলের নয়, বস্তুত এক মধ্য ইউরোপীয় ফুটবল সংস্কৃতির উত্থান দেখছি৷ খেয়াল করবেন, সংস্কৃতি, শৈলী নয়৷
এ ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হলো কি ভুল হলো, তার হেস্তনেস্ত হবে ব্রাজিলে৷