ফেসবুক অ্যাকাউন্টে হামলা!
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮আমার অ্যাকাউন্টে রিপোর্ট করে আমাকেই বানিয়ে দিলো ভুয়া অজন্তা দেব রায়৷ পরবর্তীতে অনেকগুলো আইডি ডকুমেন্টের কপি ফেইসবুককে দিয়ে অ্যাকাউন্ট ফেরত পেয়েছি৷
সর্বশেষ নিষিদ্ধ ছিলাম এই জুলাই মাসে, এক মাসের জন্য৷ আপনাদের মনে হতে পারে, কী এমন আমি লিখি যে ফেসবুক বারবার আমাকে ব্যান করে দেয়৷ এমনটা ভাবাই আসলে স্বাভাবিক৷ বিশেষ করে যাঁদের আমার লেখালেখি বা অ্যাক্টিভিজম সম্পর্কে ধারণা নেই, হয়তো মনে হতে পারে যে আমি নিশ্চয়ই ফেসবুকের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কিছু লিখেছি, তা না হলে ফেসবুক আমাকে ব্যান করবে কেন৷ আমি কি কোনো অশালীন/অশ্লীল পোস্ট করেছি? কাউকে গালি দিয়েছি? কোনো সহিংসতা উসকে দিয়েছি? সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়েছি?
উত্তর হচ্ছে – না৷
আমি আমার পুরো অনলাইন অ্যাক্টিভিজম জীবনে কখনোই একটা লাইনও এমন কিছু লিখিনি, যেটার কারণে ফেসবুকের কমিউনিটি বা এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ হতে পারে৷ তাহলে ফেসবুক থেকে আমি বারবার ব্যানড হচ্ছি কেন? এই নিয়েই আমার আজকের লেখা৷
বর্তমানে আমাদের জনজীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে ফেসবুক৷ আগে মানুষজন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলাতেন আর এখন তাঁদের অধিকাংশই বিছানা ছাড়ার আগেই মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকের নিউজফিডে চোখ বুলান৷ বন্ধু তালিকায় থাকা সকলের আপডেট নেয়া থেকে শুরু করে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও দেশের রাজনীতি কোনো কিছুই বাদ যায় না এ থেকে৷ ব্লগার, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে এই প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন করে তোলার একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে ফেসবুক৷ এ কারণেই ফেসবুকের উপযোগিতা এখন শুধু আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারগুলোতে জনমত গঠন, এমনকি জাতীয় বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নেও ভূমিকা রাখছে ফেসবুক৷
ফেসবুক ব্যবহার করে যাতে কেউ কোনো ধরনের নীতি বিবর্জিত কার্যকলাপ (যেমন, সহিংসতা ছড়ানো, পর্নোগ্রাফিক ছবি বা ভিডিও প্রচার, ভুয়া খবর ছড়ানো, বেআইনি ব্যবসা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো, অন্যের লেখা, ভিডিও বা ছবি নিজের নামে চালিয়ে দেয়া ইত্যাদি ) না করতে পারে, সেজন্য ফেসবুকে দেয়া প্রতিটি পোস্টের অডিয়েন্সের কাছ থেকে ফিডব্যাক দেয়ার একটি অপশন রেখেছে ফেসবুক৷ এর মধ্য থেকে যে কোনো একটা অভিযোগে কারো পোস্টে যদি অনেক মানুষ এক সাথে রিপোর্ট করেন, তাহলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সেই পোস্টটি রিভিউ করবে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে তা ফেসবুক থেকে ‘রিমুভ' করে দেবে– এটাই হচ্ছে মূল ধারণা৷ এমনকি কোনো পোস্টের কমেন্ট সেকশনেও যদি কেউ ফেসবুক নীতিমালাবিরোধী কোনো কিছু লেখে বা পোস্ট করে, সেজন্যও তাকে রিপোর্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে৷
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশ কিছুদিন ধরেই ফেসবুকের এই রিপোর্টিং সিস্টেমের সুযোগ নিয়ে এটাকে অনলাইনে পরিচিত ও সোচ্চার স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তমনা লেখক ও অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে অদৃশ্য একটা গোষ্ঠী৷
অনলাইনে এই উগ্র রিপোর্টিং গোষ্ঠীটা খুব সংগঠিত৷ ফেসবুকে বিভিন্ন রিপোর্টিং গ্রুপ তৈরি করেছে তারা৷ এক একটা গ্রুপে হাজার হাজার সদস্য৷ সেই গ্রুপগুলো থেকে অ্যাক্টিভিস্টদের সিলেক্টেড পোস্টে গণ রিপোর্টিং করে তারা৷ আমাদের বাংলায় লেখা পোস্টগুলো যেহেতু ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে ফেসবুক রিভিউ করে, সে কারণে এক সাথে হাজারো রিপোর্ট পেলে ফেসবুকের অটোমেটেড সিস্টেম দ্বিধায় পড়ে যায় এবং কোনো রিস্ক না নিয়ে পোস্টটা মুছে দেয়ার নোটিশ দেয়৷ এবং সেই সাথে সেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারকে ব্যান করে দেয়৷ প্রথম বার রিপোর্টিংয়ের শিকার হলে এক দিন, তারপর হলে ৩ দিন, এভাবে ক্রমানুযায়ী ৭দিন/১৫ দিন বা এক মাস এভাবে শাস্তির পরিমাণ বাড়তেই থাকে৷ পরপর ২ বার টানা একমাসের ব্যান খেলে খুব সম্ভবত ফেসবুক সেই অ্যাকাউন্টটাই ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়৷ আমার পরিচিত একজন অ্যাক্টিভিস্ট এভাবে তার আইডিটি পুরোপুরি হারিয়েছেন৷ ফেসবুক ব্যান বা অ্যাকাউন্ট ডিজঅ্যাবল হয়ে যাওয়া তাই এখন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
শাহবাগ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে মুক্তমনা ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টদের লিস্ট বানিয়ে যেভাবে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছিলো, ঠিক একই রকমভাবে এই গোষ্ঠীটা একের পর এক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের উপর করে যাচ্ছে এই ভার্চুয়াল আক্রমণ৷ গত বছরের মাঝামাঝি থেকে এই রিপোর্টিং গোষ্ঠীর হামলার প্রকোপ বেড়ে যায়৷ এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে এক ই সময়ে ফেসবুকে ব্যানের শিকার হয়েছিলাম আমরা প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন অ্যাক্টিভিস্ট৷
আমার ধারণা, তারা যাদেরকে টার্গেট করে, তাদের পুরো টাইম লাইন ঘেঁটে সেই পোস্টগুলো খুঁজে বের করে, যেগুলোতে সংবেদনশীল এমন কোনো শব্দ আছে, যেটা দিয়ে তারা রিপোর্ট করতে পারবে৷যেমন গত বছর হিন্দু সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে করা একজন মন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক একটি মন্তব্যের বিরুদ্ধে করা আমার কয়েকটি পোস্টে সেই সাম্প্রদায়িক শব্দটির ('মালাউন') উল্লেখ ছিল৷ সেই শব্দ সম্বলিত আমার প্রত্যেকটি পোস্ট রিপোর্টিং গ্রুপগুলো খুঁজে বের করেছে এবং সবগুলো পোস্টের জন্য আমি বিভিন্ন মেয়াদে ফেসবুক থেকে ব্যানড ছিলাম৷ অথচ আমার করা একটা পোস্টেও কোনো উসকানি বা অশালীন মন্তব্য ছিল না৷ শুধু সেই শব্দের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক লেখা ছিল সবগুলোই৷
যেখানে ফেসবুকে প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া, বিভিন্ন ভিডিওতে ওয়াজের নামে ভন্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের নারীবিরোধী, অশ্লীল, অশালীন কথাবার্তা প্রচার হতে দেখি, আমরা রিপোর্ট করেও তেমন কোনো লাভ হয় না, সেখানে আমরা সচেতনতামূলক পোস্ট দিয়েও আক্রমণের শিকার হচ্ছি৷ এর কারণ হচ্ছে রিপোর্টিং চক্রের সংঘবদ্ধ আক্রমণ৷
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের ক্ষেত্রে পোস্টে কী লেখা আছে বা না আছে সেটার উপরে ফেসবুকের ব্যান হয়ে যাওয়া নির্ভর করেনি৷ মামুলি পোস্টের জন্যও ব্যান খেয়েছেন কেউ কেউ৷ কোনো কোনো অ্যাক্টিভিস্ট ও যে অশালীন মন্তব্য বা পোস্ট করেন না তা না৷ কিন্তু এর সংখ্যা খুবই কম৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পোস্ট, সাম্প্রদায়িক শব্দের উল্লেখ আছে এমন কোনো পোস্ট বা ফেসবুকে মৌলবাদের মদদদাতা হিসেবে পরিচিত একজন মানুষের নামের উল্লেখ থাকলেই সেই পোস্টগুলো রিপোর্টিংয়ের শিকার হয়েছে৷
যে বা যারাই এই ভার্চুয়াল সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, তারা নিশ্চিতভাবেই আমাদের মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে চায়, কলম রুখে দিতে চায়৷ তারা চায়, যাতে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারি, উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে, একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিবোর্ড চালাতে না পারি৷
তবে তারা আসলেই মধ্যযুগীয় বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে বসবাস করছে৷ তা না হলে ঠিকই বুঝতে পারতো যে, এইভাবে ফেসবুকের একটা অ্যাকাউন্ট ব্যান করিয়ে দিয়ে কখনোই আমাদের আওয়াজ বন্ধ করিয়ে দিতে পারবে না৷ চুপ করিয়ে দিতে পারবে না আমাদের৷
এইসব করে সাময়িকভাবে হয়তো আমাদের কিছুটা হেনস্থা করতে পারছে তারা, কিন্তু কণ্ঠরোধ করতে পারবে না কখনোই– সেটা রক্ত ঝরিয়েই হোক কিংবা ফেসবুকের অ্যাকাউন্টে হামলা করে৷
কলম চলবেই৷
কি-বোর্ড কথা বলবেই৷