ফেসবুক থেকে পত্রিকার পাতায়
৩০ আগস্ট ২০১৯তবে সামাজিক যোগাযোগের শক্তিশালী এই প্ল্যাটফর্মে কোনো ঘটনা প্রকাশের পর সেই ‘জল' অনকে দূর গড়ানোর বহু ঘটনা অহরহই ঘটছে৷ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো ঘটনা যদি না আসে বা তারা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও অনেক সময় পারেনি৷ কারণ ফেসবুকে রাখঢাকহীন আলোচনার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ হাজির হওয়ায় পর অনেক ঘটনাই লাল রঙে শিরোনাম হয়েছে পত্রিকার পাতায়, আর তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে অনেকেকই৷
আপনারা নিশ্চয় ভুলে যাননি ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা এবং পরবর্তী কমান্ডো অভিযানের কথা৷ ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনীতিকপাড়ায় নজিরবিহীন এই জঙ্গি হামলা ২২ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল৷ সারারাত উৎকণ্ঠার পর সকালে শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট'। ওই অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়৷
আমার স্পষ্ট মনে আছে, সকালের কমান্ডো অভিযানের পর নিহত জঙ্গিদের নিয়ে কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছিলো না৷ ফলে নিউজরুমে সবার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল৷ এরপর আইএস এর বরাতে সাইট ইন্টেলিজেন্স পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে এদের নাম জানায়৷ এর পরদিন পুলিশ নিহত জঙ্গিদের নাম জানালেও তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে পারেনি৷ এমন সময় ত্রাণকর্তা হয়ে আসে ফেসবুক৷ জঙ্গিদের পরিচয় জানান দিয়ে একেরপর এক পোস্ট আসতে থাকে ফেসবুকে৷ নিহত জঙ্গিদের স্কুল-কলেজসূত্রে পরিচিতজনরা তাদের পরিচয় তুল ধরে পোস্ট দেন৷ গণমাধ্যমগুলোও ফেসবুকের সেই তথ্য লুফে নিয়ে প্রধান শিরোনামে লাল রঙে খবর প্রকাশ করে৷ দিনশেষে দেখা যায় ফেসবুকে মিলে যাওয়া তথ্যই ঠিক৷
পাল্টে গেল দৃশ্যপট
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টির আগে এর প্লট ছিল ঠিক উল্টো৷ নুসরাতের গায়ে যারা আগুন দিয়েছিলেন তারা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে এই ঘটনার মোড় প্রায় ঘুরিয়েই দিয়েছিলেন৷ এরপর কি হয়েছে তা সবারই জানা- ফেসবুকের কল্যাণে রাতারাতি পাল্টে যায় এই ঘটনার দৃশ্যপট৷ এখানে আমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ফেসবুকে এই ঘটনা সাড়া না ফেললে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসত কিনা বা আসল কাহিনী কতটুকু জানা যেত এবং এই হত্যার বিচার প্রক্রিয়া আদৌ এতটা ত্বরান্বিত হত কিনা- এসব সংশয় থেকেই যেত৷ নুসরাত হত্যার বিচার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যারা আওয়াজ তুলেছেন তারা একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন৷
বরগুনা পেন্ডুলাম
বরগুনার রিফাত শরীফকে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে স্যোসাল মিডিয়ায় জ্বলে উঠে ক্ষোভের আগুন৷ রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে বাহবা পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ বিতর্কিত ক্রসফায়াসের পক্ষে সাফাইও গান কেউ কেউ; যদিও তারা ভুলে যান মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের কথা৷ বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়ার আগে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যার টেলিফোনে শেষ কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়েছিল এই ফেসবুকেই, কিন্তু ভয়ে অনেকেই সেই আলোচনায় যাননি৷ ভাবটা এমন যে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে প্রজার তাতে কী আসে যায়!
আসল প্রসঙ্গে ফিরি৷ হঠাৎ করে রিফাত হত্যার আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয় ফেসবুকে৷ তাতে দেখা হয়, রিফাতকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী মিন্নি অনেকটা নির্বিকার৷ মিন্নির এই আচরণ তুলে ধরে এই হত্যার সঙ্গে তাকেও জড়িয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন অনেকে, ঝটপট গ্রেপ্তারও হন মিন্নি৷ যদিও স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির সাহসী চেষ্টার প্রথম ভিডিও দেখে গোটা জাতি তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল৷ এই হত্যায় মিন্নিকে জড়ানোর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত রয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে৷ রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও এক্ষেত্রে ফেসবুকবাসী একটু সাবধানী৷ কারণ আইসিটি আইনের কথা মাথায় না রাখলে যে ভয়ংকর বিপদ আসতে পারে, সেই উদাহরণও যে বেশ রয়েছে৷ আগের ভিডিও দেখে যারা মিন্নির জন্য গলা ফাটিয়েছিলেন, দ্বিতীয় ভিডিও সামনে এলে কৌশল বদলে চুপ হয়ে যান তারা৷
রিফাত হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে প্রকৃত ঘটনা না জেনে আমরা দ্রুত মতামত দিয়ে দেই৷ আর মূল ধারার গণমাধ্যমও অনায়াসে ফেসবুকের স্রোতে গা ভাসিয়ে অনেক সময় সেই মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে খবর, ফিচার এমনকি মানবিক আবেদন সম্পন্ন প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে৷ রিফাত হত্যার ঘটনায় ‘ফেসবুকিয় স্রোতের' বাইরে গিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তেমন একটা চোখে পড়েনি৷
অন্য একটি প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি৷ ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সেফুদা নামে পরিচিতি পাওয়া অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফাতউল্লাহর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে একটি মামলা হয়েছে৷ সেই মামলায় কি হচ্ছে, কি হবে, কি না হবে বা সরকার তার বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেবে সেই আলাপে যাচ্ছি না৷ তবে একটু না বলে পারছি না যে, বিকৃত মস্তিস্কের এই মানুষটি বিভিন্ন সময় ফেসবুক লাইভে এসে আমাদের খ্যাতিনামা ব্যক্তিদের যে কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল, আক্রমণাত্মক ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, তাকেও কিন্তু স্রেলিবেটি বানিয়েছি এই আমরাই৷ মজার ছলেই হোক আর অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হোক না কেন সেফাতউল্লাহকে প্রমোট করে নিজের মস্তিস্কেও কী ঢুকিয়ে ফেলছিনা সেই বিকৃতবোধকে! মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো যখন ফেসবুকের জোয়ারে গাঁ ভাসাচ্ছে তখন এই প্ল্যাটফর্মটিতে চূড়ান্ত রায় জানান দেওয়ার আগে একটু সতর্ক থাকাই উচিত আমাদের৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷