বইমেলা ছড়িয়ে পড়ুক
২৯ জানুয়ারি ২০১৮এবারের বইমেলায় অংশ নিচ্ছে সাড়ে চারশ' প্রকাশনা সংস্থা আর স্টল-প্যাভিলিয়নের সংখ্যা সাড়ে সাতশ'৷ মেলার পরিসর বেড়ে হয়েছে সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ বর্গফুট৷ শুধু বইয়ের মেলা নয়, আরো আছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার, আলোচনাসভাসহ নানা আয়োজন৷ প্রতিদিন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আর লেখক-পাঠকের আড্ডা তো আছেই৷ বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে এই মেলার বিস্তৃতি৷
মেলা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এবার মেলার আয়তন বেড়েছে, অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে এবং স্টলও বেড়েছে৷ এবার নতুন ১২টি প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো প্যাভিলিয়ন পাচ্ছে৷ মোট প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়েছে ২৩টি, যার মধ্যে বাংলা একাডেমির দু'টি৷''
এর আগে মেলা শুরুর দিন থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন শুরু হলেও এবার হবে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে৷ তিন দিনের এ সম্মেলন চলবে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত৷ জালাল আহমেদ আরো জানান, ‘‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দেশের বাইরে থেকে অনেক লোক আসেন, তাঁদের কথা মাথায় রেখেই এই ব্যবস্থা৷''
এই সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১১টি দেশের শতাধিক সাহিত্যিক যোগ দেবেন৷ ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, যুক্তরাজ্য, জাপান ও আফগানিস্তানসহ আরো কয়েকটি দেশের সাহিত্যিকরা এই সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন৷ মেলা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘বইমেলা আসলে একটি বড় ধরনের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজন৷ বইয়ের সঙ্গে আছে আরো অনেক কিছু৷ শিশুদের জন্য নানা প্রতিযোগিতা৷ আর মেলা শুরুর প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী বাংলা একডেমি সাহিত্য পুরস্কার তুলে দেন৷''
বাড়ছে বই, বাড়ছে বিক্রি
গতবছর (২০১৭) বইমেলায় মোট ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে৷ মেলায় মোট নতুন বই এসেছিল ৩ হাজার ৬৪৬টি৷ ২০১৬ সালে বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৪৪৪টি৷ মোট বিক্রি হয়েছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই৷ ২০১৫ ও ২০১৪ সালের বইমেলায় মোট বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২১ কোটি ৯৫ লাখ ও ১৬ কোটি টাকার বই৷ দেখা যায়, প্রতিবছরই বই মেলার পরিসর যেমন বাড়ে, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়ছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে বই বিক্রি৷
আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত বছর প্রায় চার হাজার নতুন বই প্রকাশ হয়েছে বইমেলায়৷ এবার আশা করছি আরো বাড়বে এবং তা সাড়ে চার হাজার হতে পারে৷ বইমেলাকে কেন্দ্র করেই মূলত বাংলাদেশে সৃজনশীল বই প্রকাশ হয়৷ এবং তার সংখ্যা ৯০ ভাগেরও বেশি৷ বইমেলার এক মাসে বই প্রকাশ হয় চার হাজার আর সারা বছরে হয় পাঁচশ'৷ তাই সহজেই বোঝা যায়, বইমেলা নতুন বই প্রকাশের জন্য কতটা গরুত্বপূর্ণ৷'' তবে তিনি মনে করেন, ‘‘বইয়ের সংখ্যা বাড়াই যথেষ্ট নয়, এর মান বাড়াও জরুরি৷ এ জন্য প্রকাশকদের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করতে সরকারকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা দিতে হবে৷ বইমেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের ৩০ ভাগ নবীন লেখকদের৷ সরকার উদ্যোগ নিলে প্রতিভাবান তরুণ লেখকদের বই আরো বাড়বে৷''
যেভাবে এলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা
কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে ১৯৮৩ সালে একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা'-র আয়োজনের উদ্যোগ নেন৷ কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু'জন ছাত্র নিহত হন এবং তারপর সেই বছর আর বইমেলা হয়নি৷ ১৯৮৪ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়৷
২০১৪ সাল থেকে এই বইমেলা বর্ধমান হাউজ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত হয়৷ এখন প্রকাশকদের স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই স্থান দেয়া হয়েছে৷ আর বর্ধমান হাউজ এলাকায় লিটল ম্যাগ, মিডিয়া এবং বাংলা একাডেমিসহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়৷
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘বইমেলার ইতিহাস ও নতুন আঙ্গিকে বইমেলা' শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘১৯৮৪ সালের আগেও এই বইমেলার কিছু ধারাবাহিকতা আছে৷ ১৯৬৫ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তখনকার পরিচালক কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন ঢাকা বিশ্বদ্যালয় লাইব্রেরি) শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন, যাকে ঢাকার প্রথম বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এরপর ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলারও আয়োজন করা হয়েছিল৷''
শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘‘ওই বছর বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন৷ তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান৷ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন৷ সে উপলক্ষ্যে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান৷''
ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে...
সাধারণভাবে বইমেলা হয় প্রকাশকদের৷ কিন্তু বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি৷ মেলার সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘এই বইমেলা আমাদের ভাষা শহিদ, আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের ঐতিহ্যের অংশ৷ বইমেলার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যকে তুলে ধরি৷ এই মেলার মাধ্যমে নতুন সাহিত্যিক এবং পাঠক সৃষ্টি হয়৷''
ওসমান গনি বলেন, ‘‘আমাদের বইমেলাকে ভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে নেয়ার সুযোগ আছে৷ একটি প্রকল্প করে যদি প্রতিবছর কমপক্ষে ৪০টি বইও ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায়, তাহলে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা প্রকাশকরা চাই বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক৷ এই সময়ে দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরেও অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হোক৷''
এবারও বইমেলায় নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মেলায় প্রবেশের শৃঙ্খলার বিষয়টিও৷ জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের বইমেলা৷ আমরা চাইনা, বইমেলায় প্রাণের কোনো ঘটতি থাকুক৷''
আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷