‘বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠেছিলেন’
১৬ আগস্ট ২০১৩
এ এক বিচিত্র সমাপতন৷ ১৫ই অগাস্ট একদিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের উৎসব-অনুষ্ঠান, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যায় জাতীয় শোকদিবস পালনের অনুষ্ঠান৷ দিল্লিতে আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় এক বড় মাপের নেতা হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের নির্ভীক নেতৃত্ব কী ভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের পায়ের তলার মাটি, সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন বক্তারা৷
ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম ছাড়াও বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান ও প্রাক্তন কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক-লেখক, শিক্ষাবিদ – যাঁরা শেখ মুজিবকে কাছ থেকে দেখেছেন৷ প্রত্যেকে নেতা ও মানুষ হিসেবে মুজিবের চরিত্রের নানা দিক তুলে ধরেন৷ যেমন ড. গায়েত্রী সেনগুপ্ত, যিনি সত্তরের দশকে ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন৷ ছিলেন ভারতের প্রাক্তন কূটনীতিক জি পার্থসারথী৷ তাঁরা বললেন, তাঁর বাঙালি সত্তার কথা৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা৷ তাঁর বাঙালি সংস্কৃতি- মনস্কতার কথা৷ তাঁরা মনে করেন, মুজিবের রাজনৈতিক তথা জীবনদর্শনের প্রথম ধাপ গণতন্ত্র৷ পরের ধাপ ধর্মনিরপেক্ষতা৷ এই দুয়ের মিলিত শক্তিতে তৈরি হয়েছে তাঁর মানবিক মূল্যবোধ৷
তবু তাঁকে হত্যা করা হলো কেন? কোটি টাকার প্রশ্ন৷ মুজিবের দুর্বার জনপ্রিয়তা থামাতে বিরুদ্ধ শক্তির চক্রান্ত তো ছিলই৷ তাই হত্যাকারীরা দেশের ভেতরে বাইরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে৷ তাদের বিচার হয়নি৷ শাস্তি হয়নি৷ তারা মুজিব হত্যাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছে৷ বলে বেড়িয়েছে, নিজের কৃতকর্মের ভুলেই মুজিব নিহত হয়েছেন৷ এটা একটা আইনি দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে পরবর্তীকালে অনুরূপ অপরাধীরা অব্যাহতি পেয়ে গেছে৷ কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন সেই দৃষ্টান্তকে পালটে দিতে চাইছে৷
এই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে মুজিবের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কথা৷ বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ৷ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগে এই বন্ধন পবিত্র, মহান৷ এক দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অপর দেশ যেভাবে সাহায্য করেছে, ইতিহাসে তা বিরলতম ঘটনা৷ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ ভোলেনি, ভুলবে না৷ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাশে না দাঁড়ালে ইতিহাসের গতি হয়ত অন্যদিকে যেত৷ বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেত অবশ্যই, কিন্তু আরো বেশি দুঃখকষ্ট ও রক্তপাতের বিনিময়ে৷
শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, এমন একজন বক্তা তাঁর মূল্যায়ন করেন দক্ষিণ এশিয়ার সব চেয়ে ক্যারিসম্যাটিক নেতা হিসেবে৷ মুজিবের ব্যক্তিত্বে, আচরণে ও ব্যবহারে নিমেষে সবাই আবিষ্ট হয়ে পড়তেন৷ অবিচার সহ্য করা তাঁর অভিধানে ছিল না৷ তাই তিনি গর্জে উঠেছিলেন পূর্ব বাংলার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে৷ পূর্ব বাংলার সম্পদ হরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করা বরদাস্ত করতে পারেননি তিনি৷
উন্নয়ন ছিল মুজিবের মন্ত্র৷ কিন্তু বাংলাদেশের দারিদ্র্য মোচনে তাঁর স্বপ্ন সাকার হয়নি৷ ৪২ শতাংশ মানুষ গরিব৷ তাই হাতে নিয়েছিলেন ৬ দফা কর্মসূচি৷ তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনে বাংলাদেশের আর্থিক পুনরুজ্জীবন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সংঘাত তাঁর হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছিল বলে মনে করা হয়৷
দুই বাংলার আর্থিক উন্নতিও তিনি দেখে যেতে পারেননি৷ এখনো ভারত-বাংলাদেশ বিনিয়োগ নগণ্য৷ মুজিব থাকলে হয়ত ছবিটা অন্য রকম হতো৷ বাংলাদেশকে তিনি করতে চেয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় পণ্য চলাচলের এক ট্রানজিট পয়েন্ট৷ আঞ্চলিক উন্নয়নে ভারতকে তিনি যে ভূমিকা নেবার কথা বলেছিলেন আজও তা অধরা৷ আঞ্চলিক উন্নয়ন হয়নি৷
মুজিবের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল রানার৷ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর কী ভাবে তিনি এবং তাঁর সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাসহ মুজিব-পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন, স্মৃতিচারণায় সেকথা শোনান ঐ সেনাকর্মকর্তা৷